মঙ্গলবার, ১২ মে, ২০২০

গল্পঃ আদনানের ডায়েরী

[১]
একটু আগে বেশ একপশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে । অসময়ের বৃষ্টি । তারা দুই ভাইবোন  জানালা দিয়ে বৃষ্টি পরবর্তী রংধনু দেখছে ।
রংধনুর সাতটি রং এর মতো তাদের জীবন অবশ্য রঙিন নয় ।অনেক দুঃখ কষ্টের জীবন তাদের ।ভাইটি বড় বোনটি ছোট ।
বোনটির নাম মিতা ,ভাইটির নাম আদনান। দুভাই বোন একাএকা ই থাকে ।মাঝে মাঝে তাদের বাবা আসে ।খিদে পেলে আসে । সাধারনত বাবারা বাড়ি ফিরলে সন্তানদের মুখ খুশিতে ঝলমল করে। মিতা আর আদনানের ক্ষেত্রে ঠিক তার উল্টো ।তাদের বাবা বাড়ি ফিরলে তারা দুজনে অজানা আতঙ্কে আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে পড়ে।আজানা শঙ্কায় তাদের বুকের ভেতর ঢিপঢিপ করে কাঁপে। 
কতদিন হয়ে গেল মা নেই । মা মারা গেছে । মারা গেছে বলা ভুল । মাকে মেরে ফেলা হয়েছে । মিতার কিছু মনে নেই ।কিন্তু আদনানের আছে। এখনো তার মনে পড়ে বাবা তার মাকে মারছে , কথায় কথায় মারতো। এই যেমন তরকারীতে  লবন কেন কম। ঝোল বেশী বা কম কেন । মার দেওয়া যেন রুটিন ওয়ার্ক। মা মুখ বুজে সব সইতো । এমনকি  লাঠি গুলোও সরিয়ে রাখতো না । খুবই সরল ছিল সে । 
মুখ বুজে সব সইতো । যাবার কোথাও জায়গা ছিলো না বলেই হয়তো সব সইতো । সব সইতে সইতে একদিন সে চলেই গেল না ফেরার দেশে।মিতা প্রায়ই মায়ের জন্য কাঁদে । আদনান আর কাঁদে না। এ নিষ্ঠুর পৃথিবীতে চোখের জলের কোন দাম নেই।
- দাদা খুব ক্ষিদে পেয়েছে । 
- মুড়ি খাবি ? 
-চিনি আছে দাদা ? চিনি দিয়ে মাখিয়ে খাবো । 
-নারে ? 
মিতার মুখটা শুকনো হয়ে গেল । শুধু শুধু মুড়ি  খেতে তার ভালো লাগে না  । আদনানেরও খুব ক্ষিদে পেয়েছে । ঘরে ওই মুড়ি টুকু ছাড়া আর কিছু নেই । সেদিন বাবার জামা কাচতে গিয়ে পাঁচ টাকার একটা নোট পেয়েছিলো সে ।যত্ন করে রেখে দিয়েছিলো । আগে হলে টাকাটা ফেরত দিয়ে দিতো ।এখন আর দেয় না। কি দরকার বাবা , মার খেয়ে খেয়ে এখন আর মার খেতে ইচ্ছা করেনা ।শুধু মার নয় চোর অপবাদও নিতে হবে তাকে । এই ছোট বয়সে তার জীবনের অনেক কুৎসিত দিক দেখা হয়ে গেছে ।মানুষের জীবন এত কষ্টের কেন ?   
দোকান থেকে পাঁচ টাকার চিনি কিনে দুইভাই বোন মনের সুখে মুড়ি আর চিনি খেতে লাগলো ।সকালের নাস্তাটা আজ খুব টেষ্টি ।এই ছোট্ট পাওয়াতে তাদের ভারী মজা হচ্ছে ।.............।

মানুষের জীবনের কষ্টগুলোর কোন রঙ হয় কিনা আমার জানা নেই । কিন্তু মানুষের জীবনটা অনেক বর্ণিল ।সুখ দুখ হাসি আনন্দ বেদনা নিয়েই মানুষের জীবন। সেই জীবনের ডায়রী হলো আদনানের ডায়েরী ।   

[২] 
বড় একটা ইলিশ মাছ কাটা হচ্ছে । ইলিশমাছ দিয়ে বেগুন রান্না হবে আজ । মাছটা বেশ তাজা। মিতা অবাক হয়ে মাছ কাটা দেখছে। তার চোখেমুখে হাজার বিষ্ময় । এই বয়সে প্রত্যক শিশুর চোখেই  থাকে হাজার বিষ্ময়, মনে থাকে লক্ষ কোটি প্রশ্ন । সে মনে অনেক প্রশ্ন নিয়ে বেড়ায় ,সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার লোক , সে খুজে পায় না।  
-দাদা ইলিশ মাছ কি খায়? 
ছোট বোনের প্রশ্ন শুনে আদনান অবাক হয় । তার সীমিত জ্ঞানে সে জানে না ইলিশ মাছ কি খায়। 
-জানিনা ।পোকা মাকড় খায় হয়তো । 
-পানিতে ও পোকা থাকে ? 
-হুম ।  
আমাদের বাড়ির পাশে যে ডোবা আছে ওখানে আমরা বড় হয়ে ইলিশ মাছ পুষবো।বড় বড় ইলিশ মাছ ।আমায় কিনে দিতেই হবে।দিবি তো দাদা। আদনান কি একটা বলতে যাচ্ছিলো । হঠাৎ ইসলাম সাহেব বাজখাই গলায় হাঁক ছাড়লেন।
আদনান !!
বাবার ডাক শুনলেই সে চমকে ওঠে । এটা নতুন কিছু নয় ।পৃথিবী তে এই লোকটিকে সে জমের মতো ভয় পায় ।
- জ্বী আব্বা। 
রেজা সাহেব চোখ মুখ মোটামোটা করে বললেন ,
 -শোন আজ বাড়িতে গেষ্ট আসবে । রান্না যেন ভালো হয়। খুব মন দিয়ে রান্না করবি । একটুও যেন চালাকি করবি না । লবন হলুদ তেল সব যেন ঠিক ঠাক হয় । ছয় পিস মাছ আলাদা করে ভাজবি। আর পেয়াজ ভেজে রাখবি ।বুঝেছিস। পোলাও রাধতে পারবি না? মনে আছে তো।গত সপ্তাহে তো রাঁধলি।বেশ স্বাদ লেগেছিল অবশ্য ,ওরকম করে রাধবি।
-ঠিক আছে । 
-বেশ, আর ডিমের কোর্মা করবি । ছয়টা ডিম এনেছি । আলু ভাজবি কুচি কুচি করে । দেখিস পুড়ে না যায় । অল্প জ্বালে ভাজবি। গরুর মাংসটা কষিয়ে নিবি ভালো করে ।ভুনা ভুনা করে রাঁধবি । ঝোল গামাখা গামাখা করে রাখবি । বুঝেছিস ।না বুঝলে  বল। 
আদনান একটা দীর্ঘস্বাস ছাড়লো । অবশ্যই সাবধানে । নিঃশব্দে ।আস্তে করে বলল ।
-বুঝেছি
- হ্যাঁ । 
-মাছের কি ডিম হয়েছে ? 
-না । 
-হবে না , দেখেই কেনা । মাছের ডিম হলে মাছের স্বাদ থাকে না ।যা হোক তুলে খাবি না ।আমরা খেয়ে যা থাকবে তা থেকে দেব ।মাছ কত পিস হয়েছে  গুনেছিস । 
- না গুনিনি । 
-এখনি গুনে আমাকে বল । 
-সকালে কি খেয়েছিস ? 
-মুড়ি । 
প্রায় মুখে এসে গেছিলো মুড়ি আর চিনি । দ্রুত সামলে নিলো সে ।হঠাৎ আদনানের মনে হলো মাছটা বেড়ালে নিয়ে যেতে পারে । এ পাড়ায় কালো রঙের একটা পাজি বেড়াল আছে ।খুবই সুযোগ সন্ধানী । এক দৌড়ে আদনান মাছের কাছে আসতেই দেখলো ,কালো বেড়ালটি জায়গায় হাজির ।এব্ং তার মুখে ইলিশ মাছের মাথা ।ভয়ে আদনানের শিড়দাড়া বেয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল।আজ কপালে কি কি আছে কে জানে! মিতা কাপড়ের পুতুল গুলো নিয়ে খেলছে। আদনানের এখন আর এখানে থাকতে ইচ্ছা করেনা। কবেই সে কোথায় চলে যেত।ছোট বোনটির জন্য তার খুব ভাবনা হয়।নেহাৎ তাই রয়ে গেছে ........। 
জীবনের দুঃখ কষ্টগুলো আসলেই বেশ অদ্ভুদ । জীবনের মজা মনে হয় এখানেই ।     

[৩]
এখন দুপুর তিনটা বাজে।আদনানের সব রান্না এবং আনুষঙ্গিক সব কাজ শেষ।অবিশ্বাস্য দ্রুততার সাথে সে সব কাজ করতে পারে । এই দক্ষতার সাথে হয়তো ভয়ের একটা ব্যাপার আছে । এর মধ্যে সে এবং ছোট বোনের গোসল সেরে নিয়েছে। তারা ভালো করেই জানে  রান্না সেরে তাদের কোথায় ঠাই হবে।এরকম ঘটনা এর আগে বহুবার ঘটেছে।এখন তারা চিলেকোঠার ছোট্ট ঘরটাতে আছে ।  
অতিথি আসার আগেই ইসলাম সাহেব তাদের এই ঘরে ঢুকিয়ে তালা মেরে রেখে গেছেন।এই ঘরটাতে খুব মশা।অতিথিদের হৈ হল্লা 
শোনা যাচ্ছে। এইসব কষ্টকর  সময় তার খুব মায়ের কথা খুব মনে পড়ে। মা যে কেন তাদের ছেড়ে এভাবে চলে গেল ,এটা তার জীবনের লক্ষ কোটি টাকার প্রশ্ন।কেউ তার এ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে না ।
এইঘরের একমাত্র জানালা দিয়ে আকাশটাকে অনেক কাছাকাছি আর সুন্দর দেখায়।তাকালেই মন ভালো হয়ে যায় ।আকাশে আজ বেশ মেঘ।মেঘ গুলি মনে হচ্ছে খুব ব্যস্ত ।আচ্ছা মেঘগুলি উড়েউড়ে কোথায় যায়? মেঘের মতো উড়তে পারলে বেশ হয় ।মানুষতো কখনো মেঘের মতো উড়তে পারে না ।এটাই আফসোস ।
-দাদা !মশা! 
-চুপ থাকনা বাবা ,শব্দ করিস না।বাবা বকবে। বুঝিস না কেন ।
-দাদা আমরা খাবো কখন ? কি মজার মজার খাবার।আমি কিন্তু ইলিশ মাছ খাব । 
-মিতা তোকে নিয়ে না মহা মুশকিল ।আমাদের ইলিশ মাছ খেতে নেই । বলেছিনা লোভ করবি না।বড় হয়ে তোকে একদিন ঠিক ইলিশ মাছ খাওয়াবো ।দেখিস। 
-সত্যি ।
-হ্যাঁ বাবা তিন সত্যি । তোর কি খুব ক্ষিদে পেয়েছে ?  
-হ্যাঁ খুব। 
-তোর তো শুধুই ক্ষিদে পায়।
- এই ঘরে কি খাবার আছে দাদা  ?
-দাড়া দেখি ।
আদনান গুড়ি মেরে খাটের নিচে চলে গেল ।খাটের নিচে যেমন ময়লা তেমন মশা ।সে আস্তে আস্তে খাটের নিচে লুকিয়ে রাখা টিফিন বক্সটা বের করে আনলো ।এতে সে রান্নার ফাঁকে  কিছুটা পোলাও , আলু ভাজি ,সবজি,আর দু পিস গরুর মাংস  তুলে রেখেছে ।সে ভালো করেই জানে বাড়ির অতিথিরা বিদায় হতে রাত হবে । ততক্ষণ না খেয়ে থাকতে হবে । মাছ,ডিম  সব গোনা বাকি খাবার গুলো থেকে সরালে কেউ ধরতে পারবে না।সে জানে তাদের দুই ভাইবোনের কথা কেউ ভাবে না । কেউ তাদের খেতেও ডাকবে না ।
মিতা খেতে খেতে বলল।
-দাদা তোর হাতের রান্না একেবারে মায়ের মতো। মা থাকলে খুব মজা হতো বল ।আচ্ছা মা কি কোনদিনই আসবে না।
আদনান অনেক কষ্টে একটা দীর্ঘশ্বাস লুকালো। ছোট বোনের সামনে তাকে ভেঙে পড়লে চলবেনা কিছুতেই।
-তাড়াতাড়ি খা ।বাবা যদি চলে আসে কি হবে বুঝতে পারছিস ?
তারা দুইভাইবোন মহা তৃপ্তি নিয়ে এই গরমে ঘেমে নেয়ে খেতে লাগলো । মিতার চোখেমুখে হাজার খুশির ঝিলিক ।একে চুরি করা বলে কিনা তারা জানেনা। তবে একুকু জানে এই খাবার গুলো তাদের বেঁচে থাকার জন্য খুব প্রয়োজন।সামনের জীবনের কঠিন সময়ে হয়তো এই খাবার গুলো ও ঠিক মতোজুটবে না। 
ভালোবাসাহীন পৃথিবীতে বেঁচে থাকা আসলেই কষ্ট । তবু মানুষ আশা নিয়ে বেঁচে থাকে ।একদিন ভালোদিন আসবেই    

[৪]
 দরজা খোলার খটমট আওয়াজে দুইভাই বোনের ঘুম ভাঙলো না । এখন রাত এগারোটা ।নিষ্পাপ বাচ্চাদুটো পরম নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে । দৃশ্যটি অসম্ভব সুন্দর । এই অসম্ভব সুন্দর দৃশ্যকে রেজা সাহেবের কুৎসিত মনে হচ্ছে । মাথায় আগুন চড়িয়ে দিচ্ছে ।রেজা সাহেব কেন জানি এই বাচ্চা দুটিকে সহ্যই করতে পারেন না।আগে কত ভালোবাসা সোহাগ ছিল।কত রকমের  সোহাগ আহ্লাদের সম্পর্ক ছিল।এখন তার  ছিটেফোঁটাও নে।এখনতো তার কাছে  বাচ্চা দুটোকে মনে হয়  হাড়ে বজ্জাত। ওরা সবসময় ওদের মায়ের পক্ষ নিয়ে কথা বলতো।মা ই যেন ওদের কাছে সব।খুব মায়ের ন্যাওটা ছিলো ।সেই তো মা ঠিকই তোদের রেখে উড়াল দিলো ।রাহেলা বেচে থাকাকালীন শেষের দিনগুলোতে তো তার কাছেই ভীড়তো না ছেলেমেয়ে দুটো।মা ,মা আর মা।ওদের মায়ের আত্নহত্যার পর তাকে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে ।অনেক মান অপমান সইতে হয়েছে ।জেলখাটার হাত থেকে সামান্যের জন্য বেঁচে গেছেন তিনি।নিজের বাচ্চা না হলে কবেই দূর দূর করে তাড়িয়ে দিতেন ! তাছাড়া বাড়িতে কাজের লোকও প্রয়োজন। থাক না থাক ।এই মনে করে রেখে দেওয়া । তিনি ব্যক্তিগত ভাবে মনে করেন তার নিজের চাকরিটাও গেছে ওদের মায়ের কারণে । অপয়া অলক্ষী একটা ।দুর হয়েছে ভালো হয়েছে । এখন এ দুটো দুর হলে তিনি বাঁচেন । আদনানের মামা গুলো হলো আরেক ছোটলোক  ।ইতর শ্রেণির ।বাচ্চা দুটোর দায়ভার তারাও তো নিতে পারে ! কোন খোঁজ খবরই রাখে না। যত ঝামেলা তার ঘাড়ে ।ব্যবসাটা দাড়িয়ে গেলে আবার তিনি বিয়ে করবেন ।এভাবে তাঁর আর ভালো লাগছে না । আবার তিনি নতুন জীবন গড়বেন।সুখের জীবন। সীমা ইদানিং খুব তাড়া দিচ্ছে ।কিন্তু পথের কাটা তো এদুটো।কি করে যে নামাবে। রেজা সাহেব কোন কুল কিনারা পান না।সীমাকে হত ছাড়া করা যাবেনা ।সে বাবা ময়ের একমাত্র মেয়ে । তার বাবার প্রচুর টাকা। একেবারে সোনার ডিম পাড়া হাঁস যাকে বলে । 

-আদনান এই আদনান ।
দুভাইবোনই এখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ।অনেক ধকল গেছে তাদের ওপর দিয়ে । হাজার ডাকাডাকিতে তাদের মনে হয় ঘুম ভাঙবে না। বাসা পুরোটাই এলোমেলো হয়ে আছে। থালা বাটি পরিষ্কারের ব্যাপার আছে।সব গোছগাছের ব্যাপার আছে ।ইসলাম সাহেব অবশ্য ঘর গেরস্হালী কাজ খুব একটা পারেন না ।এমনকি বিছানা তৈরি করা , মশারি টাঙানো সব আদনান করে ।আজ সে ঘুমোচ্ছে ।হঠাৎ করেই ইসলাম সাহেবের মাথায় রক্ত চড়ে গেল । তিনি ঘুমন্ত আদনানকে প্যান্ট থেকে বেল্ট খুলে পিটাতে লাগলেন ।
কিছুক্ষণের মধ্যেই আদনানের ঘুম ভেঙে গেল । এরকম পরিস্থিতিতে সে কোন দিনও পড়েনি ।পিতার অনেক নিষ্ঠুরতা সে দেখেছে । মাকে অকারণ মারধোরের দিন গুলোতে সে ছোট হলেও প্রতিবাদ করতো বলে , তাকে তার বাবা  দুচোখে দেখতে পারে না সেটাও সে জানে । কিন্তু এখন কি কারণে এই শাস্তি সে ঠিক বুঝতে পারছেনা ।হঠাৎ বিড়ালের ইলিশ মাছ খাওয়ার কথা মনে হলো ।সে দ্রুত মার বাঁচাতে বলে উঠল............।
-মেরোনা ,মেরোনা বাবা ,আমি কিছু করিনি ।
-কিছু করিনি মানে কী ? কখন থেকে ডাকছি ।শুনতে পারিস না ।হারামজাদা কথা কানে যায়না ।
-আমি কিছু করিনি বাবা । আমি মাছের মাথা খাইনি ,বিশ্বাস করো ।তুমি বিশ্বাস করো।
হঠাৎ করে মাছের প্রসঙ্গ আসাতে রেজা সাহেবের মনে পড়ে গেল তাইতো খাবার সময় মাছের মাথাটা তো পাইনি তাহলে এই হাড় হারামজাদাই মাছ টাকে খেয়েছে আর এখন মিথ্যা বলছে । রাগ আরো  চড়ে গেল তার ।তিনি জানোয়ারের মতো পিটাতে লাগলেন অসহায় বাচ্চাটিকে । মিতার ও ঘুম ভেঙে গেছে । সে বড় বড় চোখ করে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে ভাইয়ের মার খাওয়া দেখতে লাগলো ।তার খুব জল তেষ্টা পাচ্ছে। ভয়ে সে ঢোঁক গিলতে ও পারছেনা। 
পৃথিবীতে মানুষের অনেক আচরণই কুৎসিত। এজন্য মাঝে মাঝে পৃথিবীটাকে খারাপ মনে হয় ।আসলে পৃথিবীটা সুন্দর। মানুষের আচরণটাই খারাপ।এতে পৃথিবীর কোন দোষ নেই  

[৫]
শরৎ এসে গেছে প্রকৃতিতে।সূর্যের তেজ অনেকখানি কমে এসেছে যদিও। তবে রোদ্দুর এখনও গা সওয়া হয়নি ।ভোরে ঘাসের উপর ঝরা শিউলি গুলো বেশ।রোদ উঠতে সেগুলো শুকিয়ে আসে।কালফুল অবশ্য রোদ বেরুলে বেশী ঝলমল করে।দেখতেও সুন্দর লাগে। ঢাকা শহরের এদিকটায় খুব একটা কাশফুল দেখা যায়না। দুরে একটা রাজহাঁস ডাকছে সঙ্গীকে হারিয়ে ফেলেছে মনে হয়।ডাকটা বেশ কর্কশ ।দিগন্ত জোড়া আকাশে অজস্র মেঘের আঁকিবুকি খেলা।আচ্ছা ওই যে ছোট ছোট পাখিগুলির মেঘের কাছাকাছি ঘুরঘুর করছে। কেন? ক্লান্তি বলে কি কিছুই নাই তাদের ।শুধুই ওড়াওড়িনাকি অসীমকে ছুয়ে দেখার বাসনা ।আদনান অবাক হয়ে পাখীগুলো দেখে। হঠাৎ একটা রিকশার ঘন্টার শব্দে ঘোর কাটে।রিকশাওয়ালা সতর্ক করে।
-দেখে পথ চলো বাবু । 
আদনানের হাসি পায় । সে কি এখনও বাবু ।হি হি হি ।পথ চলতে চলতে হঠাৎ সে একটা গঙ্গা ফড়িং এর দেখা পেল । আকাশে বেশ শান্ত হয়ে উড়ছিলো হঠাৎ সে গা ঘেসে উড়ে গেল। আদনান দৌড়ে গেল তার পিছু পিছু । গঙ্গা ফড়িংটা কখনো ঘাসে আবার কখনো গাছের শুকনো ডালে বেশ নেচে নেচে বেড়াচ্ছে ।আদনানের এই গঙ্গা ফড়িংটা চাই ই চাই । লাল রঙের গঙ্গা ফড়িং তার অসম্ভব প্রিয় । চট করে অসম্ভব ক্ষিপ্রতার সাথে সে খুব তাড়াতাড়ি ফড়িংটা ধরে ফেলতে সমর্থ হলো । 
-কোথায় পেলিরে তুই এটাকে। 
অন্তু অবাক বিষ্ময়ে প্রশ্ন করে । লাল গঙ্গা ফড়িং তারও খুব প্রিয় । সেই দাদী বাড়ি বেড়াতে গিয়ে পদ্মার চরে উড়ে বেড়াতে দেখে ছিলো । ধরতে পারেনি অবশ্য ।ইশ এই গঙ্গা ফড়িংটাকে সে যদি নিজের করে পেতো ।
-আমায় দিবি। 
-কি । 
-ফড়িংটা । 
-তুই ফড়িং নিয়ে কি করবি । 
-সে তোর না জানলে চলবে । বিদেশী চকলেট আছে । হেব্বি মজা । আয় বদলা বদলি করি । 
-না বাবা চাইনা আমার । তুই অন্য কোথাও দেখ।আদনান বইএর ব্যাগের ভিতর থেকে কাটিম সুতো বের করলো ফড়িংটার লেজ বাধবে বলে।
-এই আস্তে ধর ওর ডানা ভেঙে গেলে তো উড়তে পারবেনা। 
-জানি জানি আমাকে জ্ঞান দিতে হবেনা।আমারটা আমি বুঝবো । 
-পাঁচ টাকা আর পাঁচটা বিদেশী চকলেট পাবি। 
-লোভ দেখাস না । 
-সত্যি বলছি । 
আদনান দ্রুত বিনিময় সেরে ফেলল ।
-শোন পরে কিন্তু আর ফেরত দেবনা । 
-ঠিক আছে । 
আদনানের  মনটা খুশিতে ভরে গেল। যাক  মিতাকে দেবে চকলেটগুলো।টাকাটাও কাজে  লাগবে । স্কুলের দেরী হয়ে যাচ্ছে  সে জোরে হাঁটতে লাগলো । জোরে না হাঁটলে ঘন্টা পড়ে যাবে ।টিচার বকাবকি করবে ।মিস জেবা তার শ্রেণি শিক্ষক । খুব ভালো মানুষ । আদনান কে সে খুব ভালোবাসে।আদনান মিস জেবার ক্লাস মিস করতে চায় না ।
সুন্দর একটা দিনে মানুষ সুন্দর সুন্দর স্বপ্ন দেখে । চারদিকের সব কিছু হঠাৎ করেই যেন সুন্দর হয়ে যায় ।আহ পৃথিবীটা সব সময় যদি এমন হতো।বেশ হতো।    

[৬]

জেবা ম্যাম ও তার পারিপার্শ্বিক ঘটনাবলী

মিস জেবা যেমন দেখতে সুন্দরী তেমন তার অমায়িক ব্যবহার ।স্কুলের প্রতিটি বাচ্চার অতি প্রিয় জেবা ম্যাম ।জেবা ম্যাম কখনো কোন ছাত্র বা ছাত্রীকে  বকা দেন না, মারেন না ।ক্লাসে একটা লাঠি পর্যন্ত আনেন না ।পড়া না বুঝলে দশ বার হলেও তিনি তাদের বুঝিয়ে দেন  এমন শিক্ষক পাওয়া এখন সত্যি দুষ্কর ।কিন্তু কেউ যদি ফাকি দেয় তখন কিন্তু তিনি ভীষণ রেগে যান ।সবাই সেটা ভালো করেই জানে আর জানে বলেই সবাই তার কথা মতোই চলে ।ছাত্রদের মধ্যে সবার ই একটা প্রচেষ্টা থাকে জেবা ম্যামের দৃষ্টি আকর্ষণ করার । জেবা ম্যামের জনপ্রিয়তার আরেকটি কারণ হলো তার সাজপোষাক ও ফ্যাশন।তিনি স্কুলে সাধারণত সুতি শাড়ি পরে আসেন।নানা রঙবেরঙের শাড়ি । আর কমবেশী সবাই খেয়াল করে দেখেছে যে এক শাড়ি তিনি দ্বিতীয় বার পরেন না এবং যা ই পরেন না কেন তাকে অপরুপ লাগে । এত শাড়ি তিনি কোথায় পান সে এক রহস্য । 
মিস জেবার সাথে আদনানের ক্লাস করিডোরে দেখা হয়ে গেল ।আজ তিনি টকটকে লাল আর সবুজ মিশানো সুন্দর একটা শাড়ী পড়েছেন।খুব সুন্দর দেখাচ্ছে তাকে।
-কি আদনান কি খবর ? 
-স্লামালেকুম [আস সালামু আলাই কুম]ম্যাম ।
- ওয়া আলায় কুমুস সালাম ।
-পড়াশোনা কেমন চলছে ?
- ভালো। 
-ছোট বোনটার খবর কি ?
-স্কুলে গেছে ম্যাম।
-ভালো ।মনে রাখবে জীবনের যে কোন পরিস্থিতিতে পড়া লেখাটা ধরে রাখবে।ওকে।
-জ্বী ম্যাম।
-সকালে কিছু খাওয়া হয়েছে । 
-হু । 
-আবার মিথ্যা , মিথ্যা বলতে নিষেধ করেছি না । করেছি ?
আদনান মাথা নাড়ালো ।
-টিফিনে আমার সাথে দেখা করো ।
-আচ্ছা 
-আচ্ছা বললেই হবে না ,দেখা করবে । আমি কাউকে মার দেয়ার পক্ষপাতি নই কিন্তু তুমি টিফিনে দেখা না করলে পিটাবো । বুঝছো ।
যাও ক্লাসে বসো । আমি আসছি । 
সপ্তম শ্রেণির এই ক্লাসে মোট বিয়াল্লিশ জন ছাত্র । আদনানের রোল বারো। প্রথম ক্লাস ইংরেজী । রোল কল শেষে মিস জেবা আজকে wh question বোঝাচ্ছেন । খুব খটমটে একটা ব্যাপার । কিন্তু কি সুন্দর যে তার বোঝাবার ভঙ্গি, মুগ্ধতা এসে যায় । আদনান পাস্ট টেনসের  ডিড এর পর প্রেজেন্ট ফর্ম বসছে কেন সেটা ধরতে পারছে না ।প্রশ্ন করতে যাবে এমন সময় বেশ একটু শোরগোল উঠলো ।এর মধ্যে কে যেনো বলছে জেবা কই রে জেবা । কোন রুমে ?
হুড়মুড় করে কিছু লোক ক্লাসে ঢকে পড়ল ।একজন মাঝবয়সী বেশ মোটাসোটা ভদ্রলোক জেবা ম্যাম এর দিকে এগিয়ে এসে রুক্ষ গলায় বলল - এই তুমি জেবা ? 
-হ্যাঁ আমি জেবা । বলুন।আপনাদের কি আমি চিনি? 
-অত চেনা চিনির কিছু নাই ।তুই আমার পোলারে কান ধইরা উঠবোস করাইছোস ক্যান। 
-কে ?বুঝতে পারলাম না ..ও...জামিলের কথা বলছেন। 
-শালী ঠিকই তো চিনস ।আমার নামও শুনছোস নিশ্চয় ।তাইলে এতো সাহস পাইলি কই ।নিজেরে কি ভাবস ।
-প্লিজ আপনার ভাষা ঠিক করুণ । ভদ্র ভাবে কথা বলুন।
-দুই দিনের মাইয়া কয় কি ওর কাছে আমার ভাষা শিখতে হইবো ।ভদ্রতা শিখতে হইবো ।সাথে সাথে জামিলের বাবার সাথে আসা লোকগুলো হে হে করে হাসতে লাগলো।বিশ্রি হাসি।
এই ফাকে আদনান গিয়ে বড় ম্যাডামকে ডেকে নিয়ে এলো ।বেশ গোলমেলে অবস্থা। সেদিন অনেক ঝামেলা হলো ।অনেক......।আদনান অত বোঝে না ।তবে শুনেছে।জেবা ম্যমকে নাকি অফিস রুমে কান ধরে দাড়িয়ে থাকতে হয়েছে।জামিলের বাবাএই এলাকার এম পি র খাস লোক। যাকে বলে ডান হাত।তাকে ঘাটিয়ে এই এলাকায় স্কুল চালানো মুশকিল।সেদিন স্কুলের ক্লাস গুলো ঠিক মতো হলো না ।এই প্রথম জেবা ম্যামকে সে কাঁদতে দেখলো। টিফিনের সময় জেবা ম্যামের ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না দেখে তার বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠলো।কেউ কেউ বলতে লাগলো জেবা ম্যাম নাকি চাকরি ছেড়ে দেবেন।আদনানের বুকটা হঠাৎ খাঁখাঁ করে উঠলো।সে স্কুল থেকে বেরিয়ে এলো ।রোদ বেশ চড়েছে ।আদনান রাস্তার এক ধার ধরে ছোট ছোট পা ফেলে হাটতে লাগলো ।
শরতের আকাশে বিভিন্ন আকৃতির অনেকগুলো মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে।আদনান আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো ।তার চোখ আদ্র হয়ে উঠেছে। সে অনেক কষ্টে কান্না চাপলো ।    
চলবে..........

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন