শনিবার, ২৩ মে, ২০২০

গল্পঃ মে ২০২০

গল্পঃ পথের মাঝে একদিন
**************************
পথের মধ্যে স্যান্ডেলটা ছিড়ে গেলো।চরম বিরক্তি নিয়ে নীলা অন্য পাটি স্যান্ডেলের দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকালো।একটা দীর্ঘশ্বাস নেমে এলো তার বুক চিরে। তারপর কি না কি ভেবে ছেড়া স্যান্ডেল জোড়া হাতে তুলল এবং পাশে থাকা ডাষ্টবিনে ছুড়ে ফেলে দিলো। নতুন একটা না কিনলেই নয়।একেবারেই গেছে।
ভাগ্যিস বাসার কাছাকাছি ঘটনাটা ঘটল না হলে কেলেঙ্কারি হয়ে যেত নিশ্চিত।তবে অসময়ে স্যান্ডেল ছিড়লো বলে তার কপালে খানিক দুঃশ্চিন্তার রেখা দেখা দিলো। মাসের শেষ এখন বাড়তি টাকার খুব আকাল। জোছনার পরীক্ষার ফি দিতে হবে, এক সপ্তাহ ধরে চাইছে।কিন্তু অফিস যেতে হলে স্যান্ডেল তো লাগবেই। হাতে মোটে আছে তিনশত টাকা।কে জানে কি হবে।
একটু আগে বেশ জাকিয়ে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে।প্রকৃতিতে এখন এই রোদ্দুর আর এই মেঘের খেলা চলছে।কি মাস এখন? নীলা মনে মনে ভাবলো, ভাদ্র মাস মনে হয় ,গতকাল মা কি যেন বলছিলো?গরমটা বেশি ছিলো বলে বলছিলো ভাদুরে গরম পড়েছে।
জোরে পায়ে হেঁটে যাবে বলে পা বাড়াতেই কে যেন ডাকলো।
-কেমন আছো নীলা?
গলাটার খুব পরিচিত না তবে কানে এসে বাজলো মনে হয়।ডাকার ভঙ্গীটা বেশ পরিচিত। নীলা ঘুরে দাড়ালোে এবং থমকে গেলো হঠাৎ করেই।
নিয়াজ দাড়িয়ে আছে দুটো বাচ্চা ছেলে সহ,সাথে একজন ভদ্র মহিলা।মনে হচ্ছে এটা তার বউ, নিয়াজ বলল,
-আমাকে চিনেছো তো নীলা?
কোন কোন পরিচিত মুখের সাথে দেখা হলে বিব্রত হতে হয়।নিয়াজ হচ্ছে সেরকমই এক মুখ।নীলার মনটা বিষাদে ছেয়ে গেলো। তবু আর কি করা, কেউ একজন ভালো মন্দ জিজ্ঞসা করলে কথা বলতে হয়।এটা স্বাভাবিক ভদ্রতা।সে ভালো হোক আর মন্দ হোক।
নীলা মাথা নিচু করে বলল ,
-ভালো আছি, আপনি ভালো আছেন?
-হ্যাঁ ভালো আছি, আগে তো আপনি করে বলতে না ,এখন আপনি করে বলছো যে,আমার সাথে লজ্জা। হা হা হা.... এখানে কোথায় থাকো? তোমার বাসা কি কাছেই নাকি?
নীলা বলবে কি বলবেনা ভাবতে ভাবতে মুখ ফসকে বলে ফেলল,
-হ্যাঁ কাছেই।
-এতোদিন পরে দেখা তোমার বাসায় ইনভাইট করবে না?
নীলা ইতস্তত বোধ করতে লাগলো। কি জন্য যে এই লোকটার সাথে তার দেখা হলো আল্লাহই জানে।কথার ফাঁদে ফেলে পাশ কাটানোর শেষ চেষ্টা স্বরুপ সে বলল,
-আপনার সাথে ইনি কে?
-এর নাম শীলা । হা হা হা .... কেমন মিল না, তোমার নামের সাথে? তোমার থেকে বয়সে তো ছোট হবে আবার সস্পর্কেও ,শীলা সালাম করো, সম্পর্কে বা বয়সে তোমার বড় যেহেতু ওকে তুমি বড় আপা বলতে পারো । নীলার এতোটাই বিরক্ত লাগছিলো যে কি আর বলবে।
এখান থেকে পালাতে পারলেই সে বাঁচে। নিয়াজকে সে বরাবরই ভয় পেয়ে এসেছে। এখনো পায়।সত্যি বলতে নিয়াজের পুরো পরিবারকে সে ভয় পায়। গুন্ডা মাস্তানের পরিবার। ভয়ের কারণও আছে। এখনো তার সেই ভয় কাটেনি।তার বুকের মধ্যে টিপ টিপ করতে লাগলো।
-তারপর কি খবর?
-এই আছি?
-এই আছি মানে কি? বর কি করে?
- বিয়ে? বিয়ে তো করিনি।
-নাকি হয়নি?একা থাকো, অন্য কোন কিছু করো নাকি?
নীলা অসহায় দৃষ্টিতে তাকায়। কথাটার ভিতর একটা সুক্ষ খোচা আছে। এই পথে লোক চলাচল কম। নিয়াজ হয়তো দিন দুপুরে তাকে কিছু করবে না। তাছাড়া মানুষ যত খারাপই হোক না কেন? নিজের বউ বাচ্চার কাছে নিজের ইমেজ খারাপ করবে না। নিয়াজ তো বুদ্ধিমান। সে নিশ্চয় সে রকম কোন খারাপ আচরণও করবে না। মন চাইছে এখান থেকে এক ছুটে সে পালায়।
-পেছনে কি দেখো?
-কিছু না।
এইবার নিয়াজের সাথে থাকা মেয়েটি বলে আপা আপনে কেমন আছেন?
বড় আপা আপনের কথা নিয়াজগো বাড়িত শুনতে শুনতে আমার কান ঝালাপালা।আপনের খুব প্রশংসা আমার শ্বশুর বাড়িত।
নীলা কি বলবে কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। ভুলে যাওয়া অতীত থেকে পালিয়ে বাঁচতে এই শহরে আসা । ভাগ্যচক্রে এখানেও সেই অতীত এসে হাজির।তার সাথে সবসময় এরকম কেন হয়?
মেয়েটি বলে চলে।আপনেরে ও এতো ভালোবাসে যে আপনের সংঙ্গে মিলাইয়া আমার নাম রাখছে। আচ্ছা আপা আপনে কেন চইলা আইলেন? মায়ে আর আব্বায় কিন্তু এহনো আপনের গুনগান গায়।
আপনেরে কিন্তু হেরা বহুত খুঁজছে।
নীলা কিছু না বলে হাটা শুরু করলো। বিভসৎ অতীতের কাছাকাছি থাকার চেয়ে পালিয়ে যাওয়াই ভালো। নিয়াজ ভালো থাক তার বউ বাচ্চা নিয়ে। সে নিয়াজের বাড়ির বউয়ের অধিকার আর ফিরে পেতে চায় না। সে আর অত্যাচারিত হতে চায় না।
**********************************************************************************************
লাশ ১ম পর্ব
*****
বেশ আঁধার থাকতে থাকতে মহী বিছানা ছাড়ে। আজ সারা রাত প্রচন্ড গরম পড়েছে। জানালা ,ঘরের দরজা সব হাট করে খোলা তবু অনবরত হাত পাখা ঘুরাতে ঘুরাতে হাত ব্যথা হয়ে গেছে ।
কাজলীর মা আবার গরম একটুও সহ্য করতে পারে না। কাজলীর ও ঘুম খুব পাতলা। শেষ রাতের দিকে হালকা একটু তাপ কমতেই মহী বিছানা ছেড়ে ওঠে।মা মেয়ে দুজনেই ঘুমাচ্ছে। বাইরে বাঁশের চৌকিতে এসে গা এলিয়ে দেয়।
নাহ! কোথাও একটু শান্তি নেই। গা চিড়বিড় করছে গরমে। গোসল করলে মনে হয় শরীরটা একটু জুড়াতো।কিন্তু বিনা কারনে সাত সকালে গোসল করলে কাজরীর মা আবার বকা বকি শুরু করে দেবে।
লোক জনের তোয়াক্কা না করেই বলবে,
-কিছু হইছে নাকি, সকাল সকাল গোছল মারাইছো? লোকে দেখে না ? কি না কি ভাববো সেই জ্ঞান টুকু আবার কবে হইবো। সাত দিনে একদিন কোন কাজ নাই আবার গোসল। আমি বইলা তোমার ঘর করি।অন্য মাগী হইলে দিতো ...............
হঠাৎ ধড়মড়িয়ে ওঠে মহী ,তাইতো আম পেকেছে যে! উত্তর পাড়ার মাঠের ধরে জঙ্গলের আম গাছ তলায় গিয়ে দেখলে হতো।বুড়োদের আমলের। বেশ ভালো ভালো জাতের আম।
বেলা এখন ভালোই ফুটে গেছে। যেই ভাবা সেই কাজ মহী উঠে দাড়ালো, যাবার আগে হাতে করে বদনা নিতে ভুল করলো না সে। জঙ্গলের ভিতরে মলমুত্র ত্যাগের মজাই আলাদা,অন্য রকমের শান্তি। বাড়িতে স্যানিটরী ল্যাট্রিন এ দম বন্ধ হয়ে আসে তার।কিন্তু পুকুরের জলে শৌচকার্য সারতে খানিক দ্ধিধা আছে তার ।
কিছুক্ষনের মধ্যে বদনা হাতে করে ,মাজায় গামছা বেধে, বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে যায় তার গন্তব্যে উদ্দেশ্যে। এদিকে লোক সমাগম সবসময়ই কম।এই এলাকাটা ভুতুড়ে বলেও বদনাম আছে।
নিজের কাজ শেষে আম কুড়াতে কুড়াতে সে এ গাছ ও গাছ ঘোরা ঘুরি করে । এখনো সেভাবে আম পাকেনি তবু সে গোটা বিশেক আম পায় । আমগুলো গামছায় মুড়ে ঘুরতে গিয়ে কিসের যেন খসমসে আওয়াজে তাকাতেই তার পিলে চমকে যায় একি!
*************
লাশ
*****
[২]
ঘন পাতার ফাঁকে খুব একটা ভালো দেখা যাচ্ছে না ।কিছু পাতা সরিয়ে ভালো করে চাইতেই বোঝা গেলো, কি যেন একটা নড়াচড়া করছে আর সেই সাথে করুণ সুরে কাতরানোর আওয়াজ।মহী নিজের অজান্তে মুখ খুলল,
-একি! মানুষ না?
হ্যাঁ এতো মানুষেরই গলার আওয়াজ।
আরো ভালো করে উঁকি মারতেই মহী থমকে গেলো।
কি আশ্চর্য এতো কুলসুম! রাকিবুলের মেয়ে কুলসুম কি করে এখানে এলো? আর ওর এই অবস্থাই বা কি করে হলো? কে করেছে এই সর্বনাশ?কে?
প্রথম অবস্থায় মহী ভাবলো গগন বিদারী এক চিৎকার দেবে। কিন্তু কেন জানি তার নিজের কণ্ঠ তার নিজের সাথেই বেইমানী করলো।সে দুই একবার গলায় হাত বুলালো।না কোন কাজ হলো না ।কোন আওয়াজ বের হচ্ছে না সেখান থেকে। এতে করে তার আতঙ্ক বেড়ে গেলো।
কি না কি ভেবে সে উদভ্রান্তের মতো দৌড় লাগালো গায়ের দিকে। মুখ দিয়ে গোঙরানি মতো আওয়াজ করে আর হাত নেড়ে, পথ চলতি লোকজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে লাগলো।
গ্রামের রাস্তায় এতো সকালে সেভাবে লোকজন নেই তবু গুটি কয়েক লোকের সাথে তার দেখা হয়ে গেলো। মুখ তখনো ফোটেনি তার চোখ দুটিতে রাজ্যের বিষ্ময়।হাতের আর গোঙরানির আওয়াজে অনেকেই বিরক্ত হলো,ধমকে উঠলোএকজন
-কি কও মিয়া ? ঠিক কইরা কও এমন করতাছো কেন?কি? ওদিকে কি দেখাও?
জামাল নামের একজন মহীর ছোটবেলার বন্ধু সে মহীকে নিয়ে রাস্তার পাশের চায়ের দোকানে নিয়ে বসালো।সে কিছু না বুঝেও একটু মাথায় পানি দিলো।মুখ ধুইয়ে দিলো।
এখন প্রচন্ড কাজের সময়। ধানের মৌসুম তবু উৎসাহী জনতার আগ্রহ কমে না।পথ চলতি আরো বেশ কিছু লোক জমে যায় সহজেই।
ধাতস্থ হতেই মহী অস্ফুস্ট স্বরে বলল,
-লাশ
-লাশ? সমস্মরে ধ্বণিত হলো । উপস্থিত সকলেই এ ওর মুখ চাওয়া চাওয়ি করলো।
কি কও?
জামাল বলল,
কোথায় লাশ?
-উত্তর পাড়ার জঙ্গলে।
এ ধরনের ঘটনা এ গ্রামে কেন এ তল্রাটে কেই কোনদিন শোনেওনি দেখেও নি। খুব তাড়াতাড়ি ছোটখাটো একটা দল চলল উত্তর পাড়ার জঙ্গলের দিকে।যদিও মহীকে তারা খুব একটা বিশ্বাস করছে না।মহীকে তারা আধ পাগলা বলেই জানে।
আজিজ মাষ্টার তার কোচিং সেন্টারে এই পথ দিয়েই যাচ্ছিলো।সে হঠাৎ থেমে দাড়ায়।এতোগুলো লোকের চলাচলে সেও খানিক উৎসাহী হয়। কি হয়েছে জানতে সেও এদের পিছু নেয়।
আলো অনেকটা ফুটে গেছে,মাঠের কাজে বের হওয়া লোকেরা অতি উৎসাহী হয়ে দলটিকে আরো ভারি করে ফেলল তাড়াতাড়িই ।
কিন্তু ঘটনার জায়গার কাছাকাছি আসতেই সবাই কেন জানি আর এগুতে চাইলো না।
জামাল স্ব উদ্যোগে এগিয়ে গিয়ে আর্ত কন্ঠে চিৎকার করে উঠলো,
- হায় আল্লাহ এতো কুলসুম। রাকিবুলের মাইয়া । এরে কেডায় এই অবস্থা করছে।
কুলসুমের নাম শুনে আজিজ মাষ্টার এগিয়ে গিয়ে দৃশ্যটি দেখে এবং হঠাৎ করেই জ্ঞান হারায়।
চলবে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন