বৃহস্পতিবার, ১৪ মে, ২০২০

ইতিহাস

এই অধ্যায়ের প্রতিটি আমার নিজের জন্য সংরক্ষিত। এই রচনা গুলো বিভিন্ন জায়গা থেকে সংগৃহিত।    

১# 
ভারতীয় স্বাধীনতার ইতিহাস।
পরাধীনতার বিরুদ্ধে বাংলার সংগ্রাম-সংগৃহীত একটি লেখা যেটাতে জানা যায় এক অজানা সংগ্রামীর নাম।
ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ – সিপাহী বিদ্রোহ – The Great Indian rebellion – সঙ্গঠিত হয় ১৮৫৭ সালে। তীতুমীরের ওয়াহাবী বাশেরকেল্লার বিদ্রোহের সময়কাল ১৮৩০ পরবর্তী । অনেক আলোচিত নীল বিদ্রোহ গুলোও সঙ্গঠিত হয় উনিবিংশ শতাব্দীর প্রথম থেকে মধ্যভাগে ।
কিন্তু সিপাহী বিদ্রোহের প্রায় আশি বছর আগে ব্যাপক বিদ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠে পুর্ব বাংলার রংপুর ও আশে পাশের অঞ্চলে। এই বিদ্রোহের নায়ক কৃষক নুরালদীন পুর্ব বাংলার অন্যতম প্রথম জাতীয়তাবাদী।
বাংলার বাংলা বিহার উড়িষ্যার শেষ নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে পলাশির যুদ্ধে মির্জাফরের বিশ্বাস ঘাতকতায় পরাজিত করে বাংলায় ইংরেজ শাসনের সূচনা হয়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর গর্ভনর ওয়ারেন হেষ্টিংস দেবী সিং নামক এক অত্যাচারী লোভী ব্যক্তিকে রংপুর অঞ্চলের ইজারাদার নিয়োগ করেন। দেবী সিং ইজারা পাওয়ার পর বেশি রাজস্ব আদায়ের জন্য প্রজাদের উপর চূড়ান্ত অত্যাচার করেন। অতিরিক্ত কর প্রদানে ব্যর্থ হয়ে দেবী চৌধারাণী সহ বহু জমিদার তাদের সম্পদ ও জমিদারী হারান। আর কৃষকরা নিঃস্ব হয়ে পড়েন। খাজনা দিতে না পারায় দলে দলে কৃষকদের জেলে পাঠানো হয়। সহায়-সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়। কৃষকদের ধরে এনে পিঠে চাবুকের কষাঘাত করা হয় ও কুড়ে ঘর আগুনে পুড়ে ছাই করা হয়। এ সময় অনেকে মহাজনের দ্বারস্থ হয়। অনেকে বনে জঙ্গলে পালিয়ে যায়। নারীদের উপর সীমাহীন অত্যাচার চালানো হয় এবং অনেককে জেলে পাঠানো হয়। কৃষককুল তাদের লাঙ্গল, বলদ, বাড়ি-ঘর সবই হারায়। এই নির্মম ও পাশবিক অত্যাচারের হাত থেকে পরিত্রাণের জন্য ১৭৮২ খ্রিষ্টান্দে রংপুর অঞ্চলে বিদ্রোহের আগুন ধুমায়িত হয়ে উঠে। কৃষকরা প্রথমে দেবী সিংহের অত্যাচার বন্ধ ও অন্যান্য দাবী পুরণের জন্য রংপুর কালেক্টরেট গুড ল্যান্ডের নিকট দাবী জানায়। গুড ল্যান্ড দাবী না মানায় এ অঞ্চলের নীপিড়িত মানুষ নুরালদীন নামক এক সংগ্রামী ও সাহসী কৃষককে নবাব হিসেবে ঘোষনা দিয়ে খাজনা দেবে না এমনকি ইংরেজ শাসন মানবে না মর্মে ঘোষণা দেয়। কৃষকের নবাব নুরালদীন এক ফর্মান জারী করে দেবী সিংকে খাজনা দিতে বারণ করেন। ১৭৮৩ সালের রংপুরের এই কৃষক বিদ্রোহ পার্শ্ববর্তী দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম সহ সমগ্র এলাকায় দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ে। বিদ্রোহীদের হাতে ডিমলার জমিদার মারা যান। দেবী সিং ও গুড ল্যান্ড সেনাপতি ম্যাকডোল্যান্ড এর নেতৃত্বে এক দল সৈন্য রংপুরের কৃষক বিদ্রোহ দমন করার জন্য প্রেরণ করেন। এই বাহিনী পথে পথে বিদ্রোহীদের বাঁধার সম্মুখিন হন এবং রক্তিক্ষয়ী যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে গ্রামের পর গ্রাম পুড়িয়ে ছাই করে দেন। নুরালদীনের বাহিনী ইংরেজ সৈন্যদের ঘাটি মোগলহাট আক্রমণ করে। এ যুদ্ধে অদম্য সাহসী কৃষকের নবাব নুরালদীন আহত অবস্থায় বন্দী হন এবং ইংরেজরা তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। এর পর দেবী চৌধারাণী, ভবানী পাঠক, কৃপানাথ, অনুক নারায়ন, শিব চন্দ্র রায়, চ্যারাগ আলী, শ্রী নিবাস প্রমূখ বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন। ভবানী পাঠক ও দেবী চৌধারানী পায়রাডাঙ্গা মঠ ও মন্দির স্থাপন করে সন্ন্যাসী বেশে আশ্রয় নিয়ে দিনের বেলা পূজা আর্চনা করত আর রাতের আধারে বেনিয়া ইংরেজদের উপর আক্রমণ চালাতো। এই মঠ মন্দিরে সন্ন্যাসীগণ ছিলেন বৈদান্তিক হিন্দু যোগী। এই সন্ন্যাসীগণ ত্রিশূল ব্যবহার করতেন। একটি সূত্র মতে বিদ্রোহীরা হিন্দু-মুসলমান ধর্মের মধ্যে ইংরেজ হটাও মন্ত্রে এক অপূর্ব সেতুবন্ধন রচনা করেন ও তাদের আচরণগত তার দৃশ্যমান ছিল। এই বাহিনীর যোদ্ধারা ছিলেন মোগল সম্রাজ্যের বেকার সৈন্য ও বাংলার ভূমিহীন নিপীড়িত কৃষক।
নুরালদীন রা পরাক্রমশালী ব্রিটিশ ওয়ার মেশীনের সামনে বেশীদিন টিকতে পারে নি সত্য। কিন্ত নুরালদীন যে জাতীয়তাবাদের বীজ বপন করে দিয়ে গিয়েছিলেন এই বাংলার বুকে – তাই ধীরে ধীরে সাওতাল বিদ্রোহ, নীল বিদ্রোহ ইত্যাদি হয়ে সর্ব ভারতীয় সিইপাহী বিদ্রোহে রুপ নিয়েছিল একশো বছরের ও কম সময়ের মধ্যে
**********************************************************************************************************
#দেশ ভাগের ইতিহাস

#দেশভাগ_১৯৪৭

পর্ব- (রাষ্ট্রের সংখ্যাঃ , নাকি ৫৬৫?)

আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে একীভূত ভারত এই সমস্যার সর্বোত্তম সমাধান ........... কিন্তু একটি বৃহৎ অঞ্চলকে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে ভিন্নমতালম্বী সরকারের অধীনে বসবাসের জন্য ঠেলে দেয়া যায় না। অতএব, সমাধান একটিই, দেশভাগ...... (ভাইসরয় লর্ড লুই মাউন্টব্যাটেন- ০৪ জুন,১৯৪৭)

এই বক্তব্য থেকে স্পষ্ট যে মাউন্টব্যাটেনের প্রত্যাশা ছিল একীভূত ভারতের কিন্তু সমসাময়িক বাস্তবতার প্রেক্ষিতে দুটি নতুন রাষ্ট্র জন্ম নেয়। কিন্তু ৫৬৫ সংখ্যাটি কিভাবে আসলো? বৃটিশ শাসনের অবসান হওয়ার পর কি এতগুলো স্বাধীন রাষ্ট্র সৃষ্টি হবার সম্ভাবনা ছিল? ১৯৪৭ সালের দেশভাগের সমসাময়িক ইতিহাসের কিছু অজানা বা কম আলোচিত অধ্যায় পর্যালোচনা করলে পরবর্তীতে সংঘটিত বিভিন্ন সমস্যা তথা কাশ্মীর,সিকিম,আসাম ইশ্যু ইত্যাদির মূল খুজে পাওয়া সহজতর হবে।

ফেব্রুয়ারী, ১৯৪৭ সালে যখন মাউন্টব্যাটেন শেষ ভাইসর হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তখন তার উপর অর্পিত ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠীর মূল এজেন্ডা ছিল জুন,১৯৪৮ এর মাঝে ভাবমূর্তি যথাসম্ভব অক্ষুণ্ণ রেখে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং পারতপক্ষে একীভূত ভারত প্রতিষ্ঠা। বুদ্ধিমান মাউন্টব্যাটেন বুঝতে পেরেছিলেন, একীভূত স্বাধীন ভারত প্রতিষ্ঠা কোনভাবেই সম্ভব হবে না এবং সেই চেষ্টা রক্তক্ষয়ী হতে পারে। তাই তিনি সম্ভাব্য গৃহযুদ্ধ এড়াতে হস্তান্তরের তারিখ এগিয়ে ১৫ আগস্ট, ১৯৪৭ নির্ধারণ করেন। সময় এগিয়ে আনার জন্য যেমন প্রস্তুত ছিলেন না নেহেরু,বল্লভভাই পাটেলের মত কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দ তেমনি ছিলেন না মুসলিম লীগ জিন্নাহর মত নেতারা। একইসাথে হকচকিয়ে গিয়েছিলেন তৎকালীন প্রায় ৫৬৫ জন প্রিন্সলি স্টেটের রাজা,মহারাজ,নবাব যারা স্বাধীনভাবে (!) রাজ্য পরিচালনা করতেন।

বৃটিশরা সমগ্র ভারতবর্ষ চষে বেড়ালেও কিছু জায়গায় সরাসরি শাসনকার্য পরিচালনা করেনি। বরং সেখানে স্থানীয় রাজা-নবাবগণ বৃটিশ সাম্রাজ্যর প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনপূর্বক শাসন কাজ চালাতেন। অন্যদিকে বৃটিশ শাসকগোষ্ঠী paramountcy এর মাধ্যমে প্রিন্সলি স্টেটগুলোর অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে সক্ষম হত। প্রিন্সলি স্টেটগুলোর আয়তন নেহায়েত কম ছিল না, ভারতবর্ষের প্রায় ৪০% এলাকা এবং ২৩% জনগণ এর মধ্যে বসবাস করতো। এর মাঝে উল্লেখযোগ্য ছিল বারোদা, হায়দ্রাবাদ, মহীশূর, জম্মু কাশ্মীর, গোয়ালিয়র, ইন্দোর,ভোপাল,কুচবিহার,ত্রিপুরা ইত্যাদি। তাদের সম্মানের মাপকাঠি ছিল তোপধ্বনির সংখ্যা। যেমন , হায়দ্রাবাদের নিজাম বা মারাঠা মহারাজার জন্য সর্বোচ্চ ২১ বার তোপধ্বনি করা হত। ইন্দোর, কুচবিহার ১৯ বার,সিকিম ১৫ বার, ত্রিপুরার রাজার জন্য ১৩ বার তোপধ্বনি করা হত। দেশ ভাগের পরিকল্পনা প্রণয়নের সময় যখন বিখ্যাত রেডক্লিফ লাইন টানতে ব্যস্ত তখন পাঞ্জাব আর বাংলার প্রায় দেড় কোটি ভুল দেশে (!) অবস্থানরত জনগোষ্ঠীর সাথে যুক্ত হয় প্রিন্সলি স্টেটগুলোর সমস্যা। মাউন্টব্যাটেন প্রিন্সলি স্টেটগুলোর উদ্দেশ্যে বলেন, তারা চাইলে ভারত বা পাকিস্তান অথবা স্বাধীন হিসেবে নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখতে পারবে। কোন শাসক কি নিজেদের কর্তৃত্বের অবসান ঘটাতে চাইবে! কিন্তু ৫৬৫টি রাষ্ট্র কি বাস্তবসম্মত?

মাউন্টব্যাটেনের রাজনৈতিক উপদেষ্টা ভিপি মেনন তাকে বুঝাতে সক্ষম হোন যে প্রিন্সলি স্টেটগুলোকে ভারতের সাথে সংযুক্ত করার মাঝেই মঙ্গল রয়েছে। তার মাধ্যমেই নেহেরু আর বল্লভভাই পাটেলের সাথে মাউন্টব্যাটেনের সুসম্পর্ক সৃষ্টি হয় আর জিন্নাহ আর মুসলিম লীগের সাথে হয় দূরত্ব। মাউন্টব্যাটেন প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে প্রিন্সলি স্টেটগুলোকে ভারতের সাথে সংযুক্ত করার ব্যাপারে সচেষ্ট ছিলেন। দেশভাগের পরে যখন বল্লভভাই পাটেল ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন, তখন ভিপি মেনন কে তার মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে দায়িত্ব প্রদান করেন। চাকুরী করেও যে রাজনীতিতে প্রভূত ভূমিকা রাখা যায় এটা তার জ্বলন্ত উদাহরণ।

পরিকল্পনা ছিল ভারতের সীমান্ত লাগোয়া রাজ্যসমূহ ভারতে আর পাকিস্তানের সীমান্ত লাগোয়া হলে পাকিস্তানে যাবে। কিন্তু পরিকল্পনা যদি এত সহজেই বাস্তবায়িত হত তবে আজ আমি কিবোর্ডে ঝড় না তুলে নির্মাণ কাজ তত্ত্বাবধায়ন করতাম। যাইহোক মাউন্টব্যাটেনের বক্তব্যের পরে ১১ জুন,১৯৪৭ ট্রাভানকোর (দক্ষিণ ভারতে অবস্থিত) রাজ্য প্রথম স্বাধীন থাকার পক্ষে মতামত প্রদান করে। পরেরদিন সর্ববৃহৎ রাজ্য হায়দ্রাবাদের নিজাম স্বাধীনতার পক্ষে বক্তব্য দেন। আগস্ট মাসের শুরুতেও প্রায় শতাধিক রাজ্য স্বাধীনতার পক্ষে অটল থাকে। মাউন্টব্যাটেন হয়তো ভাবছিলেন,অধিকার ছেড়ে দিয়ে অধিকার রাখার মত বিড়ম্বনা আর নাই! অখন্ড ভারতের স্বপ্ন তো বহুদূর, ছন্নছাড়া একটি চিত্রই প্রতীয়মান হচ্ছিল। পরবর্তীতে সবাইকে একই সুতায় গাঁথতে কোথাও প্রয়োজন হয়েছিল কূটনীতিক রাজনৈতিক দূরদর্শিতা, কোথাও বলপ্রয়োগ, কোথাও বা মাঝরাতের আচমকা সেনা অনুপ্রবেশ। (চলবে)

পরবর্তী পর্বঃ যোধপুর এবং জিন্নাহর ছোট্ট একটি ভুল

 

 

 

4242

20 comments

1 share

https://static.xx.fbcdn.net/rsrc.php/v3/yz/r/gGPRzHuW8qT.png?_nc_eui2=AeFpe203OrDpInVhGpS4r3m48rTj8cx9bmXytOPxzH1uZciQoqBFEaQ9zWAb04TEjVQVVOtFptd2McydskCbF3-DLike

https://static.xx.fbcdn.net/rsrc.php/v3/yP/r/EyGUmEdOqjv.png?_nc_eui2=AeHA4t_Ng-QkmQ5Yp4Huj4uRNEVdF6WvbZ80RV0Xpa9tn3O4wpZ_QgYYHRUnK39Y4DO1clJomcohYLZcoes4-jB4

Share


#দেশভাগ_১৯৪৭

পর্ব- (যোধপুর এবং জিন্নাহর ছোট্ট একটি ভুল)

যদি বলা হয় বর্তমান ভারতের উত্তর পশ্চিমাংশের রাজস্থানে অবস্থিত যোধপুর (তৎকালীন মারওয়ার রাজ্য) আগস্ট, ১৯৪৭ পর্যন্ত পাকিস্তানে সংযুক্ত হবার সম্ভাবনা বেশী ছিল, তাহলে হয়তো অনেকেই অবিশ্বাস করবেন। ধর্মের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা দেশভাগের সময় হিন্দু জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত এবং হিন্দু ধর্মাবলম্বী রাজা কেন পাকিস্তানের সাথে যুক্ত হবার ইচ্ছে পোষণ করবেন, তা এইযুগে বোধগম্য না হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ইতিহাস স্বাক্ষ্য দিয়ে আসছে ধর্মের ঢামাডোলে সংঘটিত সকল কর্মকান্ডের পেছনে লুকিয়ে থাকে ব্যক্তি/গোষ্ঠীগত কোন সুপ্ত বাসনা।

তৎকালীন সময়ে প্রায় ৩৬ হাজার বর্গমাইল এবং ২৫লক্ষ জনগোষ্ঠী (যার অধিকাংশই হিন্দু ধর্মাবলম্বী) অধ্যুষিত যোধপুরের রাজা ছিলেন মহারাজা হানওয়ান্ত সিং। রাজস্থানের প্রভাবশালী এই রাজা গান স্যালুট হিসেবে ব্রিটিশদের থেকে ১৭ বার তোপধ্বনি পেতেন। দেশভাগের পুর্বের পাঁচশ বছরের ইতিহাসে দেখা যায় যোধপুরের রাজা সবসময় হিন্দু ধর্মাবলম্বী ছিলেন, এমনকি মোঘল আমলেও তারা স্বায়ত্ত্বশাসন ভোগ করতেন। সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রজাদের কথাও বিবেচনা করলে নেহেরু নিশ্চিত ছিলেন যোধপুর ভারতে যোগ দিবে। কিন্তু সদ্য ক্ষমতাপ্রাপ্ত ২৩ বছর বয়সী মহারাজার চিন্তাজগতের অবস্থান পুরো বিপরীত ছিল।

জিন্নাহ বুঝতে পেরেছিলেন দ্বিজাতি তত্ত্ব, কংগ্রেসের রাজনৈতিক অবস্থান এবং মাউন্টব্যাটেনের পরোক্ষ সমর্থনে অধিকাংশ প্রিন্সলি স্টেট ভারতে যোগ দিবে। প্রতিউত্তর হিসেবে জিন্নাহ চেয়েছিলেন যথাসম্ভব পাকিস্তানের নিকটবর্তী রাজ্যগুলোকে দলে ভেড়ানো আর সম্ভব না হলে স্বাধীন থাকার ব্যাপারে উৎসাহ প্রদান করা। পাকিস্তানের করাচীর নিকটবর্তী সিন্ধু প্রদেশের সীমান্ত লাগোয়া যোধপুর এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। দিল্লীর সাথে গুজরাটের সংযোগকারী যোধপুরে পাকিস্তানের কর্তৃত্ব কংগ্রেস কখনোই মেনে নিতে পারবে না। আর হানওয়ান্ত সিং কংগ্রেসের সাথে তার কিছু মতবিরোধকে পুঁজি করে পাকিস্তানের সাথে যোগ দেয়ার মাধ্যমে রাজ্যের জন্য অতিরিক্ত সুবিধা আদায়ে সচেষ্ট ছিলেন।

দুইয়ে দুইয়ে চার হল যখন জিন্নাহ সাদা কাগজে স্বাক্ষর করে রাজা হানওয়ান্ত সিংকে তাতে ইচ্ছেমত শর্তারোপ করার জন্য অনুরোধ করলেন। হানওয়ান্ত সিং জিন্নাহর এই বদান্যতার সুযোগে করাচী বন্দর ব্যবহার আর পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশের হায়দ্রাবাদে সংযোগকারী রেললাইনের ঊপর কর্তৃত্ব দাবী করে করলেন। বিচক্ষণ জিন্নাহ সেই প্রস্তাবে সাথে সাথে সমর্থন দিয়ে বসলেন। Instrument of Accession মহারাজার স্বাক্ষর যখন সময়ের ব্যাপার মনে হচ্ছিল, তখনি বিপত্তি বাধলো।

জিন্নাহর সাথে হানওয়ান্ত সিং এর সেই সভায় আরোও উপস্থিত ছিলেন জয়সালমিরের যুবরাজ। ভৌগলিক দিক থেকে জয়সালমির পাকিস্তানের অধিকতর নিকটবর্তী। জিন্নাহ আলোচনার মাঝে জয়সালমিরের যুবরাজকেও পাকিস্তানে যোগ দেয়ার আমন্ত্রণ দিলেন। বুদ্ধিদীপ্ত যুবরাজ জাওয়াহির সিং প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন যদি সাম্প্রদায়িক সমস্যার উদ্ভব হয় তবে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় মুসলিম অধ্যুষিত সরকার কি নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে সমর্থ হবে? জিন্নাহ কিছুটা অপ্রস্তুত হলেও জবাব দিলেন এরূপ পরিস্থিতি কখনোই সৃষ্টি হবে না। হকচকিয়ে ওঠা জিন্নাহর জবাবে যোধপুরের হানওয়ান্ত সিং দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে Instrument of Accession স্বাক্ষর করার পূর্বে রাজ্যের পরিষদের সাথে আলোচনার জন্য সময় চাইলেন। তখনিই জিন্নাহ তার রাজনৈতিক জীবনের আরেকটি বড় ভুল করে বসলেন এবং হানওয়ান্ত সিং থেকে সাদা কাগজটি কেড়ে নিলেন।

জিন্নাহর এই অদূরদর্শীতার পুরো সদ্ব্যবহার করে নেহেরু, হানওয়ান্ত সিং কে মাউন্টব্যাটেনের সহযোগীতায় দিল্লীতে ডেকে পাঠালেন। ১০ আগস্ট, ১৯৪৭ সালে বল্লভভাই পাটেলের সাথে আলোচনায় ভারতের সাথে যুক্ত হওয়া ছাড়া তার সামনে আর কোন পথ খোলা ছিল না। বল্লভভাই পাটেলের সাথে মহারাজ হানওয়ান্ত সিং এর পিতার বন্ধুত্ব এক্ষেত্রে পরিপূরক হিসেবে কাজ করছিল। করাচী রেললাইনের পথ রুদ্ধ হওয়ায় রাজকোষের যে ক্ষতি হবে তা পুষিয়ে উঠতে ভারতের একটি বন্দর ব্যবহারের আশ্বাস দেয়া ছাড়া প্রকৃতপক্ষে আর কিছুই আদায় করতে সমর্থ হয়নাই।

অনেক নাটকীয়তা শেষে ১১ আগস্ট সকালে হানওয়ান্ত সিং , লর্ড মাউন্টব্যাটেনের বাসায় ভিপি মেননের উপস্থিতিতে Instrument of Accession স্বাক্ষর করেন। জিন্নাহ যদি সেদিন ক্রোধের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারতেন তবে ইতিহাস বোধহয় অন্যভাবে লেখা হত...... (চলবে)

Food for thought: চিত্রাংগদা সিং পাকিস্তানি চলচ্চিত্রে অভিনয় করছেন আর মুকেশ আম্বানীর রিলায়েন্স পাকিস্তানের ব্যবসা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইতিহাস এভাবেও লেখা হতে পারতো... উভয়ের জন্মস্থান যোধপুর

পুনশ্চঃ মহারাজা হানওয়ান্ত সিং ১৯৪৩ সালে মহারানী কৃষ্ণকুমারীকে বিয়ে করেছিলেন। দেশভাগের পর ১৯৪৮ সালে স্কটিশ নার্স স্যান্ড্রা ম্যাকব্রাইডের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলেও তা বেশীদিন টিকে নাই। অবশেষে প্রেমের আহবানে রাজ্যত্যাগ করে অভিনেত্রী জুবায়দার সাথে মেলবন্ধনে আবদ্ধ হোন। ১৯৫২ সালে তিনি রাজ্যসভার এবং লোকসভায় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং জয়ের ব্যাপারে সুনিশ্চিত ছিলেন। অথচ ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে নির্বাচনের কয়েকদিন আগে মাত্র ২৮ বছর বয়সে বিমান দুর্ঘটনায় স্ত্রীসহ মৃত্যুবরণ করেন। হানওয়ান্ত সিং আর জুবায়দা দম্পতির একমাত্র পুত্র বর্তমানে বলিউডের চলচ্চিত্র পরিচালক খালিদ মোহাম্মদ যিনি ফিজা, সিলসিলার মত কয়েকটি ছায়াছবি পরিচালনা করেছেন। বিমান দুর্ঘটনার কারণ আজোও জানা যায়নাই। সেটা কি স্বল্পনিদ্রার পর মহারাজার বিমান চালনার অদক্ষতা নাকি প্রাসাদ ষড়যন্ত্র, এখনো সদুত্তর পাওয়া সম্ভব হয়নি।

পরবর্তী পর্বঃ অপারেশন পোলো এবং হায়দ্রাবাদের নিয়তি

পর্ব ১ঃ https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=10221465740847933&id=1083044638

#দেশভাগ_১৯৪৭

পর্ব- (অপারেশন পোলো এবং হায়দ্রাবাদের নিয়তি)

মোঃ আজহারউদ্দীন আর ভিভিএস লক্ষণের দুর্দান্ত পার্টনারশিপে হায়দ্রাবাদ আজ ভারতকে এশিয়া কাপের সেমিফাইনালে পরাজিত করে প্রথমবারের মত ফাইনালে খেলার গৌরব অর্জন করলো। কমেন্ট্রি বক্স থেকে উচ্ছ্বসিত হার্ষা ভোগলে বলছিলেন, এই জয় তার জন্মস্থান হায়দ্রাবাদের ক্রিকেটীয় ইতিহাসে মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হবে। হায়দ্রাবাদের রাজা নিজাম তার রাজ্যে ক্রিকেটের উন্নয়নে নিজের পেপারওয়েট যা কিনা প্রায় ১৮৫ ক্যারটের হীরক, দান করেছেন...... ঘটনা এভাবেও ঘটতে পারতো যদি অপারেশন পোলোর ফলাফল অন্যরকম হত.........

প্রিন্সলি স্টেটগুলোর মধ্যে বৃহত্তম ছিল হায়দ্রাবাদ যা আয়তনের (প্রায় ৮২ হাজার বর্গমাইল) দিক থেকে বাংলাদেশ থেকে ঢের বড় এবং গ্রেট ব্রিটেনের প্রায় সমান ছিল। মোঘল আমলে কামরুদ্দীন খান হায়দ্রাবাদের গভর্ণর ছিলেন। ১৭২৪ সালে তার থেকে আসিফ ঝা হায়দ্রাবাদের শাসনভার গ্রহণ করেন এবং মোঘলদের হতেনিজামউপাধি লাভ করেন। দেশভাগের সময় ক্ষমতায় ছিলেন সপ্তম নিজাম জনাব মীর ওসমান আলী খান বাহাদুর। গান স্যালুটের হিসেবে সর্বোচ্চ ২১ বার তোপধ্বনি তার জন্য বরাদ্দ ছিল।

সপ্তম নিজাম ছিলেন সেই যুগের বিল গেটস। ১৮৫ ক্যারটের হীরা যা জ্যাকব ডায়মন্ড নামে পরিচিত,তিনিপেপারওয়েটহিসেবে ব্যবহার করতেন। বিখ্যাত টাইমস ম্যাগাজিনের কাভারে তাকে ধনকুবের এমনিতেই বলা হয়নাই। ছোট্ট একটি উদাহরণ দেই, তৎকালীন সময়ে নিজামের সম্পত্তির মূল্যমান ছিল বিলিয়ন ডলার। স্পষ্ট করে বোঝার স্বার্থে তা ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির প্রায় শতাংশ। আরোও স্পষ্ট করে বললে দেশভাগের পরে সমগ্র ভারতের রাজস্ব ছিল কেবল বিলিয়ন ডলার। সোনার ডিমপাড়া এই রাজহাঁস যখন দেশভাগের পরে স্বাধীন থাকার পক্ষে অবস্থান নিল, স্বাভাবিকভাবেই কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দ তা মেনে নিতে পারছিলেন না।

ট্রাভানকোরের পর ১২ জুন, ১৯৪৭ যখন নিজাম স্বাধীন হায়দ্রাবাদের পক্ষে ঘোষণা দেন, তখন ফেসবুক,টুইটার না থাকায় পত্রিকা মারফত কয়েকদিন পরে কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দ জানতে পারলেন। লর্ড মাউন্টব্যাটেন তখন পাজলের ছোট ছোট অংশ মিলাতে ব্যস্ত আর এত বড় অংশ মেলাতে গিয়ে সকল পরিকল্পনা ভেস্তে যেতে পারে বিধায় নেতৃবৃন্দও কম প্রতিক্রিয়াশীল ছিলেন। তদুপরি নেহেরু-বল্লভভাই দেখছিলেন, হায়দ্রাবাদ নিয়ে এখনি সোচ্চার হলে তা ব্রিটিশদের সাথে সম্পর্কের অবনতি ঘটাতে পারে। নিজামের দেয়া মুকুট আর গলার হার রাণী এলিজাবেথের বিয়েতে অন্যতম চমকপ্রদ উপহার ছিল। এমনকি এখনো রাণী এলিজাবেথ নিজামের দেয়া অলংকার পরিধান করে থাকেন। যেচে পরে নিজামকে ঘাটাতে গেলে যে শক্তির সঞ্চয় করতে হবে তার জ্ঞান নেহেরুর ছিল।

১৫ আগস্টের পরেও যখন হায়দ্রাবাদ স্বাধীনতার পক্ষে অনড় ছিল তখন এই কাটা সড়িয়ে ফেলতে ছক কষছিলেন নেহেরু-পাটেল সহ সকলেই। যেহেতু অধিকাংশ প্রিন্সলি স্টেট ইতিমধ্যে Instrument of Accession স্বাক্ষর করে ফেলেছিল,তাই ল্যান্ড লকড হায়দ্রাবাদের দিকে দৃষ্টি নিবন্ধন সহজতর হয়ে আসছিল। নিজ দেশের মাঝে এত বড় একটি আলাদা রাষ্ট্র ভারত কোনভাবেই মেনে নিতে পারছিল না,অন্যদিকে নিজাম তার দাবির পক্ষে অনড় ছিল। এখানে ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হোন মাউন্টব্যাটেন। তার মধ্যস্থতায় দ্বিপক্ষীয় চুক্তি হয় যার কারণে ভারতীয় বাহিনী হায়দ্রাবাদের অভ্যন্তরে প্রবেশ হতে বিরত থাকে এবং হায়দ্রাবাদকে বিশেষ মর্যাদাও দেয়া হয়েছিল। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটি কালক্ষেপণ ছাড়া আর কিছুই ছিল না।

নিজাম উপলব্ধি করছিলেন যে, স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ রাখার স্বার্থে রাজনৈতিক চালে পারদর্শী হতে হবে। ল্যান্ড লকড হায়দ্রাবাদ যদি স্বাধীন হয় তবুও তা ভারতের উপর নির্ভরশীল থাকবে বিধায় নিজাম পর্তুগীজ নিয়ন্ত্রিত গোয়া কিনে নিয়ে তার বন্দর ব্যবহার করতে চাচ্ছিলেন। ধর্মের রঙ দেয়ার স্বার্থে নিজাম সদ্যজাত পাকিস্তানকে আর্থিক সহযোগীতাও করছিলেন। তুরস্কের অটোমান সাম্রাজ্যের সাথে তার পারিবারিক সম্পর্কও যেহেতু কালের পরিক্রমায় অকার্যকর,তাই নিজাম সেনাবহর তৈরির দিকেও মনোনিবেশ করেছিলেন। কিন্তু প্রায় ২০ হাজার নিয়মিত সৈন্যের সাথে দুইলক্ষাধিক রাজাকার (অনিয়মিত আধা সামরিক বাহিনী) কতটুকু দেশরক্ষা করতে পারবে তা প্রশ্নবিদ্ধ ছিল।

অন্যদিকে ভারত কালক্ষেপণের কৌশলে জয়ী হয়ে হায়দ্রাবাদে সেনাসমাবেশ ঘটিয়ে পর্যুদস্থ করার প্রয়াস চালাচ্ছিল। এদিকে মাউন্টব্যাটেন ভারত ছেড়ে চলে যাওয়ায় হায়দ্রাবাদ ছিল বন্ধুশূণ্য। নিজাম বুঝতে পারছিলেন যে সেনা আগ্রসন আসন্ন। তাই মানববর্ম হিসেবে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের উপর নির্যাতন শুরু করেছিল কাশেম রিজভির মত রাজাকার কমান্ডার। অপরদিকে নিজাম চাচ্ছিলেন জাতিসংঘের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। এই সুযোগটির অপেক্ষায় ছিল ভারত সরকার। রাজাকার কর্তৃক নিপীড়নকে ইশ্যু হিসেবে দেখিয়ে সেনাসমাবেশের মাধ্যমে নিজামকে পরাস্ত করা হয়েছিল।

১৩ সেপ্টেম্বর,১৯৪৮ শুরু হওয়া অপারেশন পোলো স্থায়িত্ব ছিল মাত্র দিন। সুসজ্জিত ভারতীয় সেনাবাহিনীর সামনে একেবারেই দাড়াতে পারেনি নিজামের সেনা রাজাকার। জাতিসংঘের দরজায় কড়া নেড়ে ব্যর্থ নিজামের শেষ আশা ছিল জিন্নাহ পাকিস্তানে যোগদান। কিন্তু কাশ্মীর ইস্যুতে ব্যস্ত জিন্নাহর দৃষ্টিভংগিতে কখনোই হায়দ্রাবাদ পাকিস্তানের অংশ ছিল না।

অপারেশন পোলো তৎকালীন সময়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু জনগোষ্ঠী ভারতীয় সেনাবাহিনীর নির্যাতনের অনুসন্ধানে নেহেরু সুন্দরলাল কমিটি গঠন করেন। সেই প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রায় ৪০ হাজার সাধারণ মানুষের প্রাণহানি হয়েছিল। অন্যান্য সূত্র সেই সংখ্যাকে লক্ষাধিক বলেও দাবি করে। এদের মাঝে অনেকেই হয়তো কিছুদিন পূর্বে ব্রিটিশ ছাড় আন্দোলনে গান্ধী-নেহেরুর অনুসারী ছিলেন।

Blood diamond মুভিটি অনেকেই দেখেছি। সেই যুগে হায়দ্রাবাদ হীরার অন্যতম প্রধান উৎস ছিল। গোলকোন্ডার হীরা ছিল জগত বিখ্যাত। বিখ্যাত কোহিনূর, দারিয়া নূর থেকে শুরু করে সমসাময়িক অনেক বিখ্যাত হীরার জন্মস্থান ছিল হায়দ্রাবাদ। অপারেশন পোলোর পরে ভারত সরকার নিজাম তার পরিবারের ৯৭% অর্থ বাজেয়াপ্ত করে নিয়েছিল। তদুপরি ১৯৬৫ ইন্দো-পাক যুদ্ধের পরে ভারত সরকারের অনুরোধে নিজাম ন্যাশনাল ডিফেন্স ফান্ডে ৫০০০ কেজি স্বর্ণ বিনিয়োগ করেছিলেন। সেই বিনিয়োগের মুনাফার খোজ আজোও নিজামের নামে প্রতিষ্ঠিত ৫২ টি ট্রাস্টের কোনটিই খুঁজে পেল না।

পরবর্তী পর্বঃ জুনাগড় জিন্নাহর পাশার ছক

পূর্বের পর্বঃ https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=10221479800079405&id=1083044638

#দেশভাগ_১৯৪৭

পর্ব- (জুনাগড় জিন্নাহর পাশার ছক)

সেই সময়ে রাজা-নবাবদের অনেক খেয়ালী ইচ্ছের কথাই আমরা শুনেছি। কিন্তু তাড়াহুড়ায় নিজের স্ত্রী-সন্তানকে ভুলে পোষ্য কুকুরকে সাথে নিয়ে জাহাজে চেপে বসার নজির বোধহয় খুব বেশী নেই। হ্যা, কথা বলছি জুনাগরের নবাব মোহাম্মদ মহব্বত খানজির।

ভারতের পশ্চিমাঞ্চলে গুজরাটের নিকটবর্তী তুলনামূলক ছোট প্রিন্সলি স্টেট ছিল জুনাগড়। প্রায় সাড়ে তিনহাজার বর্গমাইলের রাজ্যে অবস্থিত ছিল বিখ্যাত সোমনাথ মন্দির। নবাব মুসলিম হলেও প্রজাদের প্রায় ৮০ শতাংশ ছিল হিন্দু ধর্মাবলম্বী। সার্বিক পরিস্থিতি হায়দ্রাবাদের মত মনে হলেও জুনাগড় হায়দ্রাবাদের মত প্রতিষ্ঠিত ছিল না। অথচ ছোট এই প্রিন্সলি স্টেট দাবার বোর্ডের সৈন্যের মত পুরো বোর্ড দাপিয়ে বেড়াচ্ছিল। বল্লভভাই পাটেল চাচ্ছিলেন যেকোনভাবেই হোক হায়দ্রাবাদ ভারতে আসুক, কাশ্মীর না আসলেও চলবে। কিন্তু জুনাগড় ছিল সেই ওয়াইল্ড কার্ড যা পুরো দৃশ্যপট পাল্টে দিয়েছিল।

দেশভাগের দৃশ্যপটে জুনাগড় প্রথম থেকেই ভারতে সংযুক্ত হবার ইচ্ছে প্রকাশ করে আসছিল। সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু জনগোষ্ঠী আর রাজ্যের পূর্বের ইতিহাস পর্যালোচনা করে এই সিদ্ধান্তে আসতে খুব বেগ পেতে হচ্ছিল না। আবার ভৌগলিক অবস্থান বিবেচনা করলে তা ছিল রাজস্থানের নিকটে আর চারদিকে ভারত দ্বারা বেষ্টিত। শুধু আরব সাগরে ছোট একটি অংশের মাধ্যমে তা যুক্ত ছিল। প্রিন্সলি স্টেটগুলোর নবাব/প্রতিনিধিদের সাথে ২৫ জুলাই, ১৯৪৭ অনুষ্ঠিত আলোচনায় জুনাগড়ের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন জনাব নবী বক্স,যিনি একাধারে নবাবের উপদেষ্টা এবং দেওয়ান বা প্রধানমন্ত্রী খান বাহাদুর আবদুল কাদির মোহাম্মদ হোসেনের সহোদর। নবী বক্স সেখানে মাউন্টব্যাটেনকে আশ্বস্ত করেছিলেন যে জুনাগড় ভারতের সাথে যুক্ত হবে এবং এই ব্যাপারে তিনি নবাবের নিকট তদবির করবেন। মুসলিম লীগও জুনাগড়ের ব্যাপারে খুব বেশী আগ্রহ প্রকাশ না করায় কংগ্রেস ভাবছিল নবাবের Instrument of Accession স্বাক্ষর করা কেবলি সময়ের ব্যাপার। কিন্তু এমন ম্যাড়মেড়ে টেস্ট ম্যাচ বোধহয় ভারতবিধাতার সহ্য হচ্ছিল না।

জুনাগড়ের নবাব মহব্বত খানজি পশুপ্রেমিক ছিলেন। তার সংগ্রহে শতাধিক কুকুর ছিল। বিলাসিতার চরম নিদর্শনরূপে তার দুটি কুকুরের মাঝে ঢাকঢোল পিটিয়ে বিয়ের আয়োজন করেছিলেন। শুধু তাই না কুকুর দম্পতির সেই মাহেন্দ্রক্ষণে রাষ্ট্রীয় ছুটি পর্যন্ত ঘোষণা করেছিলেন। গান স্যালুটের হিসেবে ১৩ বার তোপধ্বনি বরাদ্দ ছিল। নবাব সাহেব আবার মঞ্চে নৃত্য এবং অভিনয় করতেন। তার রাজকীয় মঞ্চে সকল কস্টিউম, গহনা এমনকি অস্ত্র পর্যন্ত আসল ছিল। ভোগ বিলাসে অতিময় মত্ত থাকার দরুণ তিনি রাষ্ট্রীয় কাজে ফুরসত কম পেতেন। তাই অমোঘ নিয়মে দুর্বল নবাবের সহায়ক শক্তি হিসেবে উঠে এসেছিল দেওয়ান এবং আমলাতন্ত্র।

১৯৪৭ এর শুরুর দিকে নবাবের মন্ত্রীপরিষদে মুসলিম লীগ নেতা শাওনেওয়াজ ভুট্টোর আবির্ভাব হয়। নাম পরিচিত লাগছে? হ্যা,তিনিই জুলফিকার আলী ভুট্টোর পিতা এবং বেনজির ভুট্টোর দাদা জনাব শাহনেওয়াজ ভুট্টো। দ্রুতই নবাবের আস্থাভাজন হয়ে ১৯৪৭ দেশভাগের দামামার মধ্যে শাহনেওয়াজ ভুট্টো নবাবের দেওয়ান বা প্রধানমন্ত্রীর আসনে আসীন হোন। মজার ব্যাপার হল তিনি স্থলাভিষিক্ত হয়েছিলেন পূর্বের দেওয়ান মোহাম্মদ হোসেন এর যার আমন্ত্রনে তাকে পূর্বে মন্ত্রীসভার সদস্য করা হয়েছিল। একেই বলে সূচ হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বের হওয়া। এই আগমনে নবাবের সাথে মুসলিম লীগের সুসম্পর্ক তৈরি হয়েছিল আর কংগ্রেসের সাথে দূরত্ব। প্রকৃতপক্ষে শাহনেওয়াজ ভুট্টো তার গুরু জিন্নাহর নির্দেশনার প্রতিপালন করছিলেন মাত্র।

কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দ জুনাগড়ের টালমাটাল অবস্থান দেখে খুব একটা দুশ্চিন্তায় ছিল না। তাদের মনে হায়দ্রাবাদ,কাশ্মীর এমনকি ট্রাভানকোর নিয়েও যে ভয় ছিল, তার লেশমাত্র জুনাগড়ের ব্যাপারে লক্ষ্য করা যাচ্ছিল না। আর অন্যদিকে খেলারাম খেলে যাচ্ছিল।

১৯৪৭ এর আগস্টে ভারতের পক্ষ থেকে Instrument of Accession স্বাক্ষরের জন্য নবাব বরাবর পাঠানো হয়েছিল। ১২ আগস্ট পর্যন্ত কোন প্রতিউত্তর না পেয়ে তাকে টেলিগ্রাম করাও হয়েছিল। শাহনেওয়াজ ভুট্টো তার জবাবে বলেছিলেন, বিষয়টি বিবেচনাধীন আছে। ১৯৪৭ এর ১৫ আগস্ট, মাহেন্দ্রক্ষণ যেদিন জুনাগড়ের নবাব Instrument of Accession স্বাক্ষর করে তা প্রতিস্বাক্ষরের জন্য প্রেরণ করেছিলেন। ফেসবুক, টুইটার না থাকায় সেই সংবাদ সকালে চায়ের টেবিলে পত্রিকা মারফত বল্লভভাই পাটেল জানতে পারলেন। বিনা মেঘে বজ্রপাত ঘটেছিল, কেননা জুনাগড় পাকিস্তানের সাথে যুক্ত হবার জন্য ঘোষণা দিয়েছিল।

নেহেরু, পাটেল এবং মেননের মত সংশ্লিষ্ট সকলে এতে নড়েচড়ে বসে। পাকিস্তানকে কয়েকদফা টেলিগ্রাম করেও কোন উত্তর পাওয়া যাচ্ছিল না। বার্তাবাহকের মাধ্যমে চিঠির কোন উত্তর নেই। ১৩ সেপ্টেম্বর পাকিস্তান সরকার ঘোষণা করে যে জুনাগড় এখন পাকিস্তানের অংশ এবং ১৬ আগস্ট Instrument of Accession গৃহীত হয়েছে। ব্যাকডেট তখনো ছিল বোধহয়!

হায়দ্রাবাদের রাজাকার নেতা কাশিম রিজভী দাপটের সাথে বলেছিলেন, ভারত জুনাগড়কে নিয়ন্ত্রনে আনতে পারছে না আর হায়দ্রাবাদ চায়! জিন্নাহ ঘোষণা দিলেন জুনাগড় করাচী থেকে বেশী দূরে নয় এবং সার্বভৌম পাকিস্তানের অংশ হিসেবে তাকে যেকোন মূল্যে রক্ষা করা হবে। পরিস্থিতি বিবেচনায় মেনন দ্রুত জুনাগড় সফর করলেন। কিন্তু নবাব অসুস্থ (!) এবং নবাবজাদা ক্রিকেট ম্যাচে ব্যস্ত থাকায় শাহনেওয়াজ ভুট্টোর সাথে সাক্ষাত করে ফিরে আসতে হয়েছিল। ধুরন্ধর মেননের মানসপটে তখন ছিল দুর্ধষ রাজনৈতিক মারপ্যাচ।

সমলদাস গান্ধী, মহাত্মা গান্ধীর ভাতিজা মেননের সমর্থনে বোম্বেতে বসে জুনাগড়ের অস্থায়ী সরকার গঠন করে বসেছিলেন। গণতন্ত্রের ধোয়ায় ভারতের বক্তব্য ছিল জনগণের সরকারকে মেনে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। নেহেরু-পাটেল বুঝতে পেরেছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু জনগোষ্ঠী হওয়ার পরেও মুসলিম নবাবের প্রভাবে জুনাগড় ভারতে যুক্ত না হলে হায়দ্রাবাদ বা কাশ্মীর কোনদিন আসবে না। এই মারপ্যাচে জুনাগড়ের কয়েকজন জমিদার ভারতের পক্ষে যুক্ত হবার ঘোষণা দিয়েছিল। জমিদারদের এই বিদ্রোহ দমনে জুনাগড়ের নবাব সেনা প্রেরণ করেন। তখন কংগ্রেস জমিদারদের মাধ্যমে যুক্ত হওয়া অঞ্চলকে ভারত হিসেবে বিবেচনা করে তার সীমান্তে প্রতিরক্ষার জন্য সেনা প্রেরণ করে,যদিও তারা জুনাগড়ের সীমানায় তখনো প্রবেশ করে নাই।

ভারতীয় বাহিনীর উপস্থিতিতে নবাব ঘাবড়ে গিয়েছিলেন কেননা তখনো পাকিস্তান তার অংশ (!) জুনাগড়কে রক্ষায় কোন সেনাবহর প্রেরণ করে নাই। নবাব আত্মরক্ষার্থে দ্রুত জাহাজে চেপে করাচী চলে গিয়েছিলেন। পালানো কালে তিনি তার এক স্ত্রী আর পুত্র রেখে কুকুরদের সাথে নিয়ে জাহাজে চেপে বসেছিলেন। শাহনেওয়াজ ভুট্টো তখন ঘোষণা দিয়েছিলেন যে নবাব তার ক্ষমতাটুকু ভুট্টোকে দিয়ে গিয়েছেন এবং পরিস্থিতি বিবেচনায় তিনি ভারতের সাথে যুক্ত হবেন। কিন্তু নবাব নিজে যখন লিখিতভাবে পাকিস্তানে যুক্ত হতে স্বাক্ষর করেছিলেন সেখানে তার দেওয়ানের উলটো বক্তব্য কতটুকু গ্রহণযোগ্য?

ভুট্টোর কথার সূত্রধরে ভারতীয় বাহিনী জুনাগড়ে প্রবেশ করে অন্তবর্তীকালীন প্রশাসক নিয়োগ করেছিল। নেহেরু এই আপডেট লিয়াকত আলী খানকে প্রেরণ করলেও তার জবাবে লিয়াকত শুধু হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছিলেন, তর্জন গর্জন কেবল ছিল, একশন নয়!

ভারতের চিন্তায় ছিল যেকোন মূল্যে জুনাগড়কে নিয়ে আসা, কিন্তু ইতিমধ্যে যে রাজ্য পাকিস্তানে যুক্ত হয়েছে তাকে হালাল (!) উপায়ে নিয়ে আসার পন্থা কি হতে পারে? কংগ্রেসের বক্তব্য ছিল জনগণের রায় মেনে নিতে হবে, নবাবের ইচ্ছা-অনিচ্ছা প্রাধান্য পাবে না। ইতিমধ্যে প্রশাসক নিয়োগের মাধ্যমে সামলদাস গান্ধীর অন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রয়োজন ফুরিয়ে গিয়েছিল, তাই তার সাথে সকল সম্পর্ক অস্বীকার করা হচ্ছিল। এখন হালাল পন্থা হিসেবে বেছে নেওয়া হল গণতন্ত্রের প্রধানতম অস্ত্র, গণভোট।

জিন্নাহ-লিয়াকতের মূল পরিকল্পনা তখন স্বার্থক মনে হচ্ছিল। যদি গণভোটের মাধ্যমে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ কিন্তু মুসলিম নবাব চালিত রাজ্য ভারতে যুক্ত হতে পারে তবে একই পন্থা কেন কাশ্মীরে প্রয়োগ করা যাবে না! এককাঠি সরেস পাকিস্তান সরকার ভোট পর্যবেক্ষণে আন্তজার্তিক এবং পাকিস্তানের পরিদর্শক নিয়োগ দিতে মনস্থ করেছিলেন। এসব অগ্রাহ্য করে স্থানীয় প্রশাসন দ্রুত গণভোটের আয়োজন করেছিল। ভোটের ফলাফলে দেখা গিয়েছিল ৯৯.৯৫% ভোট পেয়ে জুনাগড়ের জনতা ভারতে যুক্ত হতে চাচ্ছিল। জুনাগড় অধিগ্রহণে আর কোন বাধা রইলো না.................

জুনাগড় যুক্ত হবার পর নব উদ্যমে ভারত হায়দ্রাবাদের উপর চেপে বসে। দুই রাজ্যের পরিস্থিতি অনেকটা একইরকম ছিল, জুনাগড় তবুও আরব সাগরের সাথে সামান্য অংশ যুক্ত ছিল। পাকিস্তান তখন দৃষ্টি নিবন্ধন করেছিল তার মূল লক্ষ্য কাশ্মীরের দিকে। যে যুক্তিতে জুনাগড় ভারতের হয়,সেই একই যুক্তিতে কাশ্মীর পাকিস্তানের অংশ হতে পারে। কিন্তু কে জানতো জুনাগড়ের গণভোটের মাধ্যমে প্রাপ্ত রায়ের পন্থা কাশ্মীরে গিয়ে হারিয়ে যাবে............. (চলবে)

পূর্বের পর্বঃ কমেন্টে

#দেশভাগ_১৯৪৭

পর্ব- (কাশ্মীর-স্বর্গের পতন)

We have lost Kashmir…. – মহারাজা হরি সিং (শ্রীনগর হতে পশতুন উপজাতিদের আক্রমণে জম্মু পালিয়ে আসার পর)

দেশভাগের সবচেয়ে জটিল এবং একইসাথে বেদনাদায়ক ইশ্যু হচ্ছে কাশ্মীর যার প্রভাব এখনো এই উপমহাদেশ বয়ে বেড়াচ্ছে। সময়ের প্রভাব অন্যান্য সকল ইশ্যুকে শান্ত করতে পারলেও এখনো এই ভূস্বর্গ তার ক্ষত বহন করছে। এক্ষেত্রে ঘটনাপ্রবাহ জটিল এবং ভ্যারিয়েবল অনেকগুলো, যার একটিও যদি উল্টোরথে যেত তবে কাশ্মীরের ভবিষ্যৎ হয়তো অন্যরকম হতে পারতো। সংগত কারণেই একে এক পর্বেসীমিত আকারেফুটিয়ে তোলা সম্ভব নয়।

তৎকালীন জম্মু-কাশ্মীর রাজ্যের বর্তমান বিভাজন অনেকটা এই রকমঃ

- উত্তরাঞ্চল তথা উত্তর-পশ্চিমে গিলগিট,বালতিস্তানে (বেলুচিস্তান নয়) পাকিস্তান অধ্যুষিত কাশ্মীর যা আজাদ কাশ্মীর নামেও পরিচিত

- দক্ষিণ-পূর্বে কাশ্মীর ভ্যালি,লাদাখ এবং জম্মুতে ভারত অধ্যুষিত কাশ্মীর যা জম্মু কাশ্মীর নামে পরিচিত

- পূর্বে সাক্সাম ভ্যালি এবং আকসাই চীন যা বর্তমানে চীন কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত

তবে ঘটনার মূলে যেতে হলে শুধু ১৯৪৭ এর সমসাময়িক ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ যথেষ্ট নয়। ১৪শ শতাব্দী পর্যন্ত কাশ্মীর বিভিন্ন সময় হিন্দু এবং বৌদ্ধ রাজা দ্বারা পরিচালিত হয়ে আসছিল। ১৩৩৯ সালে শাহ মীরের মাধ্যমে মুসলিম শাসন শুরু হয়। এরপর আকবরের হাত ধরে মোঘল আর তারপর এসেছিল আফগানের দুররানী সাম্রাজ্য। ১৮১৯ সালে প্রভাবশালী শিখ নেতা রণজিৎ সিং এর হাত ধরে মুসলিম শাসনের অবসান হয়েছিল। শাসকের ধর্ম যদিওবা পরিবর্তিত হচ্ছিল কিন্তু কাশ্মীরবাসীর অসাম্প্রদায়িকতা সবযুগেই প্রশংসনীয় ছিল। প্রায় ৫০০ বছর ধরে গড়ে উঠা সুফিবাদের বটবৃক্ষ ছায়া মেলে ধরেছিল পুরো কাশ্মীর ভ্যালিতে।

রণজিৎ সিং শাসনামলের শুরুতে কাশ্মীরবাসী ভেবেছিল দুররানী অপেক্ষা হয়তো শিখ সাম্রাজ্য অপেক্ষাকৃত উদার হবে। মোহ ভঙ্গ হল যখন পাঞ্জাবের রণজিৎ সিং লাহোরে বসে কাশ্মীরে আজান নিষিদ্ধকরণ, জামিয়া মসজিদ বন্ধ এবং গোহত্যার শাস্তি হিসেবে শিরচ্ছেদের প্রচলন শুরু করলেন। অপরদিকে সেই রণজিৎ সিং ১৮৩২ দুর্ভিক্ষের সময় খাজনা অর্ধেক, বিনা সুদে ঋণ দিয়ে এবং কাশ্মীরের শাল কে বিশ্বব্যাপী পরিচয় করিয়ে দিয়ে প্রজাদের কল্যাণে মনোনিবেশ করেছিলেন। তিনি জানতেন সোনার ডিম দেয়া কাশ্মীর তার দ্বিতীয় সর্বোচ রাজস্বের উৎস, তাই প্রজাপালনে তার ভূমিকা প্রশংসনীয় হয়ে উঠছিল যদিওবা ধর্মীয় কিছু অপ্রিয় সিদ্ধান্ত কাশ্মীরবাসীর মনে স্থায়ী ক্ষত করে রেখেছিল।

সেইসময় জম্মুর রাজা রণজিৎ দেও কে হটিয়ে পাঞ্জাবের শিখ সাম্রাজ্য বিস্তার লাভ করে। জম্মুর রাজার নাতী গোলাব সিং, শিখ রণজিৎ সিং এর নিকট আশ্রয় কাজের জন্য প্রার্থনা করেন। পরবর্তীতে হিন্দু ব্যক্তিত্ব গোলাব সিং কে জম্মুর গভর্ণর ঘোষণা করে রণজিৎ সিং পাঞ্জাব ফিরে যান। এই গোলাব সিং পরবর্তীতে শিখ সাম্রাজ্য বিস্তারে এবং পুরো কাশ্মীর ভ্যালি, লাদাখ, বালতিস্তান জয়ে প্রভূত ভূমিকা পালন করেন। গোলাব সিং এর আবির্ভাব উত্থান কাশ্মীর ইশ্যুতে প্রথম ভ্যরিয়েবল হিসেবে ধরা যায়। জম্মুর ইতিহাসে তাকে সবসময় সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে দেখা গিয়েছিল।

১৮৪৬ সাল.... রাজা রণজিৎ সিং তখন আর নেই। দ্বিধাবিভক্ত শিখ সাম্রাজ্য দখলের এই সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করে নাই ব্রিটিশ রাজ। সংঘটিত হয় প্রথম এংলো শিখ যুদ্ধ। যেই শিখ সাম্রাজ্যের হাত ধরে জম্মু-কাশ্মীরে গোলাব সিং এত উচ্চতায় আসীন হলেন,বিপদের কালে তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। যুদ্ধে শিখ সাম্রাজ্য পরাজিত হল। তখন মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় ফিরে এসেছিলেন গোলাব সিং। স্বাক্ষরিত হল লাহোর চুক্তি যার কারণে শিখদের বিশাল অংকের টাকা জরিমানা হিসেবে গুণতে হয়েছিল।

কিন্তু ছন্নছাড়া শিখদের এত অর্থ কই! ব্রিটিশদের হিসেব ছিল টাকা দিতে না পারলে জমি দাও। এবার সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেছিলেন গোলাব সিং। গুণে গুণে ৭৫ লক্ষ নানকশাহী রূপী দিয়ে কিনে নিয়েছিলেন জম্মু-কাশ্মীর। জ্বী হ্যা, গোলাব সিং ক্রয় করেছিলেন জম্মু-কাশ্মীর! অমৃতসরের চুক্তি মোতাবেক ব্রিটিশ থেকে বাগিয়ে নিয়েছিলেন মহারাজা উপাধি আর শিখদের থেকে মুক্ত হয়ে স্বীকার করে নিয়েছিলেন ব্রিটিশদের আনুগত্য। পত্তন হয়েছিল হিন্দু ডোগড়া সাম্রাজ্য।

আগেও বলেছি প্রথম ভ্যারিয়েবল হচ্ছে গোলাব সিং এর উত্থান। কারণ ডোগড়া সাম্রাজ্যের মাধ্যমেই প্রথম পুরো কাশ্মীর ভ্যালি, লাদাখ, জম্মু, গিলগিট,বালতিস্তান একত্রিত হয়েছিল। একীভূত না হলে হয়তো দেশভাগের সময় বিচ্ছিন্ন অংশ নিয়েই কর্তারা সন্তুষ্ট হয়ে যেতেন।

রাষ্ট্র সেবামূলক প্রতিষ্ঠান, ব্যবসায়িক নয়। রাষ্ট্র পরিচালনা কেবলমাত্র আর্থিক লাভ-ক্ষতি বিবেচনার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনা। কিন্তু যে সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন হয়েছিল নগদ অর্থে কিনে নেয়ার মাধ্যমে সেখানে কি এই মূলনীতি প্রযোজ্য? শতবর্ষ পরে দেশভাগের সমসাময়িককালে যখন পুরো ভারতবর্ষে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন চলছিল তখন কাশ্মীরে উত্থান হয়েছিল জাতীয়তাবাদের। শতবর্ষী ডোগড়া সাম্রাজ্য পরিচালনা করছিলেন মহারাজা হরি সিং। ১৯২৫ সালে অধিষ্ঠিত হওয়া মহারাজা হরি সিং জাত প্রথা নিরসনে মূখ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। তদুপরি অনেক বিশ্লেষকের মতে কাশ্মীর সমস্যার দায়ভার বহুলাংশে বর্তায় মহারাজা হরি সিং এর উপর। মহারাজার সিদ্ধান্তহীনতা আর ক্ষমতা আকড়ে রাখার মানসিকতার কারণে কাশ্মীরের জনতার ইচ্ছে বলি হয়েছিল।

জাতীয়তাবাদের উত্থান আর রাজতন্ত্রের পতনের দাবী নিয়ে সোচ্চার হয়ে উঠে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র, শেখ আবদুল্লাহ। মুসলিম কনফারেন্স এবং পরবর্তীতে গড়ে উঠা ন্যাশনাল কনফারেন্সের নেতা শেখ আবদুল্লাহ মুসলিম হিসেবে কাশ্মীরবাসীদের হতে গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছিলেন। শেখ আবদুল্লাহ চাচ্ছিলেন রাজতন্ত্রের পতন এবং গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা। প্রিন্সলি স্টেটগুলোতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হলে কংগ্রেসে সুবিধাজনক অবস্থানে চলে আসতো। কেননা তখন হিন্দু জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বকারী মুসলিম নবাব-রাজাগণ পাকিস্তানে যোগ দেয়ার ইচ্ছে ত্যাগ করতে বাধ্য হতেন। ১৯৩৭ সালে শেখ আবদুল্লাহর সাথে পরিচয় হয় জওহরলাল নেহেরুর। দুজনের একই মনোভাব আর চেতনায় গড়ে উঠে প্রগাড় বন্ধুত্ব যা কাশ্মীর ইতিহাসের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ভ্যারিয়েবল।

মুসলিম শেখ আবদুল্লাহর সাথে ছিল নেহেরুর বন্ধুত্ব যার কারণে কংগ্রেসের সাথে মহারাজার দূরত্ব তৈরি হয়েছিল। অপরদিকে জিন্নাহর মুসলিম লীগের সাথে ধর্মগত কারণে মহারাজা ভীড়তে পারছিলেন না। দ্বন্দ শুরু হয় চার পক্ষেরঃ নেহেরু-জিন্নাহ-মহারাজা হরি সিং এবং শেখ আবদুল্লাহ। কাশ্মীরের ইতিহাসে এই চারটি পক্ষই খুবই গুরুত্বপূর্ণ যেই বিরোধের জের আজোও বয়ে বেড়াচ্ছে কাশ্মীরবাসী..... (চলবে)

পূর্বের পর্বঃ https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=10221633143352891&id=1083044638

 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন